ইরানের পরমাণু প্রকল্প নিয়ে পশ্চিমাদের এত ভীতি কেন?

ইরানের পরমাণু প্রকল্প!
ইরানের পরমাণু প্রকল্প! | ছবি: সংগৃহীত
0

গেলো দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে বিশ্বব্যাপী খবরের শিরোনামে রয়েছে ইরানের পরমাণু প্রকল্প। মার্কিন অনেক প্রেসিডেন্টই নানা সময়ে ইরানকে নিষেধাজ্ঞার আওতায় এনেছে। সেই সঙ্গে বহু বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্যে আঞ্চলিক যুদ্ধ আতঙ্ক তো রয়েছেই। কিন্তু একসময় দেশটির পরমাণু প্রকল্পে সহযোগিতা করা যুক্তরাষ্ট্র এখন কেন তেহরানের পরমাণু কার্যক্রম বন্ধে উঠে পড়ে লেগেছে? পরাশক্তির দেশ ইরানের পরমাণু প্রকল্প নিয়ে কেনই বা এতো ভীতি পশ্চিমাদের?

ইরানের শেষ শাহ ছিলেন, শাহ মোহাম্মদ পাহলাভি। তার আমলে ১৯৫০ সালে প্রথম শুরু হয় ইরানের পরমাণু কার্যক্রম। সেসময়টা যুক্তরাষ্ট্র চাইতো, মিত্র দেশগুলোর পরমাণু সক্ষমতা থাকুক। তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার জন্য রিঅ্যাক্টর তৈরিতে সহযোগিতা করেছিলো যুক্তরাষ্ট্র। শাহ পাহলাভী চেষ্টা করেছিলেন, রিঅ্যাক্টর গ্রিডগুলো দিয়ে শহরগুলোতে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিতে।

১৯৭০ সালে ফ্রান্স আর পশ্চিম জার্মানির সঙ্গে চুক্তি হয়, আরও রিঅ্যাক্টর তৈরির। সেই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র সম্মতি জানায়, ইউরেনিয়াম প্রক্রিয়াজাত আর সমৃদ্ধকরণে। সেসময় তেহরানকে মিত্র হিসেবেই বিবেচনা করতো পশ্চিমারা।

কিন্তু পুরো পরিস্থিতি বদলে গেলো ১৯৭৯ সালের ইসলামী বিপ্লবের পর। শাহকে হটিয়ে ক্ষমতা দখলে নিয়ে দেশে ইসলামিক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করলেন রুহুল্লাহ খোমেইনি।

এরপর ইরানের সব পরমাণু প্রকল্পের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। পশ্চিমারা পিছু হটায় কাঁচামাল সংকটে অনেক প্রকল্প স্থগিত হয়ে যায়। ১৯৮০ থেকে ১৯৯০ সালে আবারও পরমাণু প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু করে তেহরান।

ইসলামিক প্রজাতন্ত্র চুক্তি স্বাক্ষর করে রাশিয়া আর পাকিস্তানের সঙ্গে। শুরু হয় নাতানজ আর আরাক কেন্দ্রের কার্যক্রম। কিন্তু দানা বাঁধতে থাকে সন্দেহ, কারণ অনেককিছুই চলছিলো গোপনে। অবগত ছিলো না আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা।

২০০২ সালে প্রকাশ্যে আনা হয় নাতানজ আর আরাক পরমাণু প্রকল্প। যা তাক লাগিয়ে দেয় পশ্চিমাদের। আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা জানায়, পরমাণু অস্ত্র বানানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে তেহরান।

সেসময় জাতিসংঘে প্রস্তাব পাশ হয়, ইরানে ইউরেনিয়াম প্রক্রিয়াজাত আর সমৃদ্ধকরণ স্থগিতে। নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয় প্রতিরক্ষা, জ্বালানি আর ব্যাংকিং খাতে। এরপর ২০১৫ সালে বিশ্বের শীর্ষ ছয় শক্তিশালী দেশ, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, রাশিয়া আর চীনের সঙ্গে জয়েন্ট কম্প্রিহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন স্বাক্ষর করে ইরান।

চুক্তি অনুযায়ী, ইরান সর্বোচ্চ তিন দশমিক ছয় সাত শতাংশ পর্যন্ত ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করতে পারবে। মজুত করতে পারবে ৩০০ কেজি সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম। ফলে হাজার হাজার সেন্ট্রি ফিউজ ধ্বংস করা হয়। বিনিময়ে ইরান পায়, আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা থেকে মুক্তি। আন্তর্জাতিক বাজারে অবাধে কেনা-বেচা শুরু হয় ইরানের জ্বালানি তেলের।

কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় এসে ২০১৮ সালে এই চুক্তি থেকে বেরিয়ে যান। তার দাবি ছিলো, চুক্তির পরও ইরান ব্যালিস্টিক মিসাইল তৈরি করছে আর সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে সাহায্য করছে।

২০২১ সালে জো বাইডেন ক্ষমতায় আসার পর জানুয়ারিতে জানা যায়, ফোর্দো পরমাণু কেন্দ্রে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ ২০ শতাংশে উন্নীত করেছে তেহরান। এপ্রিলের দিকে জানা যায়, ইউরেনিয়াম ৬০ শতাংশ সমৃদ্ধ করে ফেলেছে ইরান।

শুধু তাই নয়, ৯০ শতাংশ পর্যন্ত পরমাণু অস্ত্র তৈরির জন্যও প্রস্তুত তারা। যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বলছে, ইরান যদি চায়, কয়েক সপ্তাহের মধ্যে পরমাণু অস্ত্র তৈরি করতে পারে। ইরানের ভূগর্ভস্থ ড্রোন আর মিসাইলের শহর সেই প্রমাণই দেয়, প্রতিরক্ষায় কতোটা এগিয়ে তেহরান।

যদিও তেহরান বরাবরই বলে আসছে, শান্তিপূর্ণভাবে পরমাণু কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে তারা। কিন্তু ইসলামি প্রজাতন্ত্রের এই দেশের পরমাণু প্রকল্প নিয়ে বরাবরই উদ্বেগ পশ্চিমা বিশ্বের। ডোনাল্ড ট্রাম্প পুনরায় ক্ষমতায় আসার পর থেকে ইরানকে পরমাণু ইস্যুতে চুক্তিতে আসতে চাপ দিয়ে আসছেন। ইরানের ক্রমাগত ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণে সম্ভাব্য হামলা ঠেকাতে মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক সক্ষমতাও বাড়িয়েছে ওয়াশিংটন।

পরমাণু ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র–ইরানের আলোচনা কতোটা ফলপ্রসূ হবে, সেই বিষয়ে এখনই নিশ্চিত করে কিছু বলা না গেলেও মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি–সংঘাত অনেকটাই নির্ভর করছে এই চুক্তির ওপর, এমনটাই মত বিশ্লেষকদের।

এএইচ