স্বপ্ন ছিল, দক্ষিণ এশিয়ার কোন দেশে ভালো চাকরি হবে, কিন্তু গন্তব্য হয়েছে কারাগারে। বন্দি থেকে জোরপূর্বক সাইবার ক্রাইমের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে এসব ভুক্তভোগীকে। বিভিন্ন দেশ থেকে থাই - মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে পাচার করে আনা এই বন্দিদের অনেক সময় মারধর, নির্যাতন করা হয়, দেয়া হয় ইলেকট্রিক শক।
থাইল্যান্ড-মিয়ানমার সীমান্তে প্রতারক এই চক্রে ফেঁসে গেছেন বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ইথিওপিয়া, চীনের শতাধিক নাগরিক। প্রতিনিয়ত হতে হচ্ছে নির্যাতনের শিকার।
এক ভুক্তভোগী জানান, তারা ক্লায়েন্টের নম্বর দিতো, হোয়াটসঅ্যাপ থেকে তাদের মেসেজ দিতাম। কথা বাড়িয়ে ফন্দি আটতে হতো কিভাবে তাদের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নেয়া যায়। কিন্তু আমরা তো স্ক্যামার না। আমরা ভুক্তভোগী। তারা আমাদের ব্যবহার করে। কেউ কাজ করতে না চাইলে আমাদের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে নেয়ার ভয় দেখানোর হতো। তাদের অনেক বড় বাজার রয়েছে, যেখানে মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিক্রি হয়, এই ভয় দেখিয়ে তারা আমাদেরকে দিয়ে কাজ করিয়ে নিতো।
সশস্ত্র গোষ্ঠীরা থাই-মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে পাচার করা বিভিন্ন দেশের নাগরিককে এভাবেই মিয়ানমারে পাঠিয়ে দেয়। তাদের রাখা হয় সীমান্তের কুখ্যাত কমপাউন্ডে।
সারা বিশ্বের মানুষকে প্রতারিত করার মতো জঘন্য কাজ করানো হতো তাদের দিয়ে। কাজ করতে অস্বীকৃতি জানালে দেয়া হতো প্রাণনাশের হুমকি। সম্প্রতি রয়টার্স, গার্ডিয়ানসহ পশ্চিমা ও এশিয়ান বিভিন্ন গণমাধ্যমে উঠে এসেছে এমন প্রতিবেদন।
আরেক ভুক্তভোগী বলেন, ‘আমাকে অনেক শাস্তি দেয়া হয়েছে। প্রতিদিন ইলেকট্রিক শক দিতো। শাস্তির কারণ জানতাম না। ১৮ ঘণ্টা করে কাজ করতাম কোন বেতন ছাড়া। পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে দিত না। আমাদের অর্থনীতির যে অবস্থা, আমরা ভালো থাকতে চাই। চীন এই সুবিধা নেয়। আমাদের মিথ্যা বলা হয়, জানায় আমাদের কাজ করতে হবে ব্যাংককে। এরপর মিয়ানমার নিয়ে আসে।’
বিষয়টি সামনে আসে, যখন মিয়ানমার, চীন আর থাইল্যান্ড যৌথভাবে উদ্যোগ নেয় স্ক্যাম সেন্টারগুলো খুঁজে বের করে ভুক্তভোগীদের উদ্ধার করে নিজ দেশে প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা করার।
এখন পর্যন্ত মিয়ানমার থেকে চীনা প্রায় ২শ' মানুষকে নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হয়। থাইল্যান্ডে ফেরত পাঠানোর প্রস্তুতি চলছে।
টেলিকম প্রতারণার ফাঁদে পড়া আরো প্রায় ৮শ' চীনা নাগরিককে সামনে দেশে ফিরিয়ে আনা হবে। প্রতারক চক্রের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে বিভিন্ন দেশের অন্তত ৭ হাজার মানুষ। টেলিকম প্রতারণা রুখতে হাত মিলিয়েছে এই তিন দেশ।
চলতি মাসের শুরুতে মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠী ডেমোক্রেটিক কারেন বুদ্ধিস্ট আর্মি এমন প্রতারণার শিকার ২শ' ৬০ জনকে থাই সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করেছে।
এছাড়াও মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী পাঁচটি এলাকায় দুই সপ্তাহ আগে বিদ্যুৎ, ইন্টারনেট সংযোগ আর জ্বালানির সরবরাহ স্থগিত করে দিয়েছিলো থাই কর্তৃপক্ষ।
তাদের ধারণা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অবৈধ অনলাইন অপারেশনের সঙ্গে জড়িত হাজার হাজার মানুষ। পেছনে কাজ করছে, চীন, মিয়ানমার, থাইল্যান্ডসহ আরও অনেক দেশের প্রতারক চক্র।
কেবল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় নয়, অনলাইন স্ক্যামের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে সারাবিশ্বে। প্রতারিত হচ্ছেন এশিয়া, আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ আমেরিকার শত শত মানুষ।
যুক্তরাষ্ট্রের ইনস্টিটিউট ফর পিস বলছে, এই প্রতারণা থেকে বিশ্বব্যাপী ৬ হাজার ৩শ ৯০ কোটি ডলার আয় হয়। এরমধ্যে ৩ হাজার ৯শ কোটি ডলার আসে কম্বোডিয়া, মিয়ানমার ও লাওস থেকে।
জাতিসংঘ বলছে, মিয়ানমারের ১ লাখ ২০ হাজার নাগরিক আর কম্বোডিয়ার ১ লাখ নাগরিক অবৈধ এই প্রতারণা চক্রের সঙ্গে জড়িত। বিগত কয়েক বছর ধরে সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে এভাবেই অবৈধ কার্যক্রম চালিয়ে আসছে।