এশিয়া
বিদেশে এখন
0

রাজনৈতিক কারণে ইসরাইলের সঙ্গে কঠোর হতে পারছে না যুক্তরাষ্ট্র

ইসরাইলের সঙ্গে হামাস, হিজবুল্লাহ, হুথির মতো ইরান সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠীর সহিংসতা চরমে। যার ফলে মধ্যপ্রাচ্য এখন অনিবার্য সংঘাতের দিকে যাচ্ছে। এতো সংকটের মধ্যেও মিত্র দেশকে দমাতে কোনো কার্যকর ভূমিকাই রাখতে পারছে না একসময়ের ক্ষমতাসীন যুক্তরাষ্ট্র। সংবাদমাধ্যম সিএনএনের বিশ্লেষণ বলছে, দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে সংঘাতের প্রভাবমুক্ত রাখতেই ইসরাইলের সঙ্গে কঠোর হতে পারছে না মার্কিন প্রশাসন।

লেবাননে যোগাযোগ যন্ত্র পেজার আর ওয়াকি-টকি বিস্ফোরণে এতো হতাহতের ঘটনার পর থেকে হিজবুল্লাহ প্রধান হাসান নাসরাল্লাহ নিহতের ঘটনা পর্যন্ত, ইসরাইলকে অনেকভাবেই ওয়াশিংটন অনুরোধ করেছিলো, মধ্যপ্রাচ্যে চলমান এই সংঘাত যেন আর না বাড়ানো হয়। সেই অনুরোধকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে গেলো সপ্তাহেই লেবাননে স্থল অভিযান শুরু করে ইসরাইলের সামরিক বাহিনী।

গেলো বছরের ৭ অক্টোবর যেভাবে গাজায় সেনা অভিযান শুরু করেছিলো আইডিএফ। অথচ এই অভিযান শুরুর কয়েকঘণ্টা আগেও খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছিলেন, এখনই যুদ্ধবিরতি প্রয়োজন আর এই বিষয়ে তিনি আশাবাদী।

যদিও অস্ত্র দিয়ে মদদ দেয়া মিত্র দেশের প্রেসিডেন্টের আহ্বানকে বারবার অবজ্ঞা করে সম্প্রতি ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহু বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যে এমন কোনো স্থান নেই যেখানে ইসরাইল প্রবেশ করতে পারে না। কিন্তু সমরাস্ত্র দিয়ে এতো সহযোগিতার পরও কেন ইসরাইলে কমছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব?

সংবাদ মাধ্যম সিএনএনের বিশ্লেষণ বলছে, ৫ নভেম্বর নির্বাচনকে সামনে রেখে বিদায়ঘণ্টা বাজছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের। নিজ দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধের কোনো প্রভাব পড়তে দিতে চান না এই নেতা। যে কারণে ইসরাইলকে চাপ প্রয়োগ করতে পারছে না যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির নির্বাচনে প্রভাব আছে নেতানিয়াহুর। অন্যদিকে, কিছু সীমাবদ্ধতা আছে আরেক ডেমোক্রেট প্রার্থী কামালা হ্যারিসের।

যদিও এর আগে তিনি বলেছিলেন, নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেবেন, কিন্তু নেই দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ।

সিএনএনের বিশ্লেষণ বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের ব্যর্থতা তখনই প্রকাশ পেয়েছে, যখন গেলো ৭ অক্টোবরের পর থেকে গাজায় অনবরত সামরিক অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে ইসরাইল। নেতানিয়াহু সবসময় আগে পদক্ষেপ নিয়ে এরপর যুক্তরাষ্ট্রকে জানাচ্ছে।

ইসরাইলের এসব পদক্ষেপে যুক্তরাষ্ট্র পরিণত হয়েছে দর্শকে। মাসের পর মাস কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে যুদ্ধ বন্ধ করতে চাইলেও ব্যর্থ হয়েছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন। যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানালেও তা তোয়াক্কাই করছে না হামাস কিংবা ইসরাইল কোনো পক্ষই।

অথচ বিশ্লেষকরা বলছেন, নেতানিয়াহুকে থামানোর ক্ষমতা আছে শুধু যুক্তরাষ্ট্রের।

দ্য অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি সেন্টার ফল আরব অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজের পরিচালক অধ্যাপক কারিমা লাচির বলেন, ‘এখন অনেক বড় রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হয়েছে। এই মুহূর্ত এখন নেতানিয়াহুর নিয়ন্ত্রণে। ইসরাইলকে বিপজ্জনক পদক্ষেপ নেয়া থেকে শুধু যুক্তরাষ্ট্রই বিরত রাখতে পারতো। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এখন নিজ দেশে নির্বাচনের কারণে অন্য কোনো ঝামেলায় জড়াতে চাইছে না।’

এই যুদ্ধবিরতি কার্যকরে কূটনৈতিক ব্যর্থতা শুধু যে লজ্জার তা নয়, যখনই মার্কিন কোনো প্রেসিডেন্টের আহ্বান এভাবে অমান্য করা হচ্ছে, তখনই প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে সুপার পাওয়ার যুক্তরাষ্ট্র। কিছুদিন পর হোয়াইট হাউজ ছেড়ে দিলেও মধ্যপ্রাচ্য সংকট সমাধানে কোনো ভূমিকাই রেখে যেতে পারছেন না বাইডেন।

অন্যদিকে আবার ইহুদি রাষ্ট্রটিকে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দেয়ার সব দায়িত্বও যেন যুক্তরাষ্ট্রই নিয়েছে। উল্টো এখন পর্যন্ত মার্কিন ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ইসরাইলবান্ধব প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করেছেন বাইডেন। যদিও এই সহযোগিতাকেও অনিবার্য প্রাপ্তি হিসেবে ধরে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া বোমা দিয়েই হিজবুল্লাহ প্রধান হাসান নাসরাল্লাহকে হত্যা করেছে আইডিএফ।

এই অবস্থায় নেতানিয়াহু আর বাইডেনের সম্পর্ক নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে বিশ্ব সম্প্রদায়ে। সামরিক বিশ্লেষকরা বলছেন, লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলে ইসরাইলের সামরিক অভিযান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঠিক কী আলোচনা হয়েছে, তা অস্পষ্ট। কারণ স্থল অভিযানের বিস্তারিত কিছুই যুক্তরাষ্ট্র জানে না। এই অভিযানের পরিধি সীমিত করতে বাইডেন প্রশাসন জোর দিচ্ছে।

অন্যদিকে ইসরাইলের উত্তরাঞ্চলের জন্য হুমকি হিজবুল্লাহকে পুরোপুরি গোড়া থেকে উপড়ে ফেলতে মাঠে নেমেছে আইডিএফ। পুরো অঞ্চল ছড়িয়ে পড়ছে সংঘাত।

অধ্যাপক কারিমা লাচির আরও বলেন, ‘পশ্চিমা নেতাদের বিষয়টি নিয়ে ভাবা উচিত। বিশেষ করে ইসরাইলকে বলা উচিত বোমা হামলা বাদ দিয়ে শান্তি ফিরিয়ে আনতে। কারণ আপনি আপনার ডানে বায়ে হামলা করলে আপনার দেশের মানুষও নিরাপদ না। এই অঞ্চলে যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হওয়া মানে অনেক সাধারণ মানুষের ক্ষয়ক্ষতি।’

এখন পর্যন্ত গাজা, লেবানন, ইরান, সিরিয়া থেকে বিপজ্জনক অনেক শত্রুকেই সমূলে উৎপাটন করে বিশ্বে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের মাথাব্যথা, এই সামরিক অভিযানে সাধারণ মানুষের মৃত্যু আর যুদ্ধ থামাতে না পারার ব্যর্থতার দায় নিয়ে।

পাশাপাশি মার্কিন মুলুকের উদ্বেগ, যতদিন এই অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা থাকবে, সংঘাত হয়ে পড়তে পারে বহুমুখী। ইরান আর যুক্তরাষ্ট্র যেকোনো সময় হতে পারে মুখোমুখি। অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যয় নেমে আসলে যুক্তরাষ্ট্রকে ছাপিয়ে বিশ্বের নতুন সুপার পাওয়ার হয়ে যেতে পারে চীন।

সংবাদ মাধ্যম সিএনএনের বিশ্লেষণ বলছে, যুক্তরাষ্ট্র দ্বিরাষ্ট্র সমাধান চাইলেও ৭ অক্টোবর নিজ দেশে হামাসের হামলা ঠেকাতে ব্যর্থ হয়ে নেতানিয়াহু এই আগ্রাসন বাড়িয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে, মধ্যপ্রাচ্যে নিজের আধিপত্য বিস্তারে বিষাক্ত সাপের মতোই কাজ করছে যুক্তরাষ্ট্র। গাজা লেবাননে যুদ্ধ ঠেকাতে বাইডেন প্রশাসনের ব্যর্থতা ডেমোক্রেটিক পার্টি থেকে বিচ্ছিন্ন করবে প্রগতিশীল আরব-আমেরিকান ভোটারদের, বিশেষ করে সুইং স্টেটগুলোতে।

আবার ইসরাইলকে শাস্তি দেয়ার যেকোনো পদক্ষেপ বিপাকে ফেলবে কামালা হ্যারিসকে। যে কারণে আরও উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে যুদ্ধ দীর্ঘায়িত করছেন বেনইয়ামিন নেতানিয়াহু।