চলতি সপ্তাহে পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে এভাবেই জোরালো প্রতিপক্ষ হিসেবে মুখোমুখি সাবেক দুই প্রধানমন্ত্রী। দীর্ঘ নির্বাসন শেষে দেশে ফিরেই প্রধানমন্ত্রিত্বের পথ সুগম করতে মরিয়া নওয়াজ। আর জেলে বসেই নির্বাচনে দলকে জেতানোর পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছেন ইমরান।
নজিরবিহীন সময় পার করছে পাকিস্তান। ক্ষোভ, হতাশা, আশা জট বেঁধে এক অদ্ভুত পরিস্থিতি। ২৪ কোটির বেশি জনসংখ্যার মুসলিম অধ্যুষিত দেশটি তৃতীয়বারের মতো এগোচ্ছে বেসামরিক সংসদ নির্বাচনের দিকে। সামরিক শাসন আর একনায়কতন্ত্রের দীর্ঘ ইতিহাস লালন করা পাকিস্তান পৃথিবীর একমাত্র দেশ, যেখানে আজ পর্যন্ত কোনো প্রধানমন্ত্রীই মেয়াদ শেষ হওয়া পর্যন্ত টিকতে পারেননি। ৮ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনও সেনাবাহিনীর ছায়া এড়াতে পারছে না বলে চলছে গুঞ্জন।
পাকিস্তানের ইতিহাসে কোনো নির্বাচনই বিতর্ক ছাড়া হয়নি। কিন্তু আসছে নির্বাচন যেন বিতর্কের সব সীমা পার করেছে। একদিকে দুর্নীতিসহ বিভিন্ন মামলায় কারাবন্দি সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান, নির্বাচনে অংশ না নিতে পারলেও জেলে বসে দলকে জেতানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন।
অন্যদিকে, একাধিক ফৌজদারি মামলায় দোষী সাব্যস্ত আরেক সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ। হঠাৎই স্বেচ্ছা-নির্বাসন ত্যাগ করে দেশে ফিরেই শুরু করেছেন নিজের ওপর থেকে যাবতীয় অভিযোগ মেটানোর কাজ।
আঞ্চলিক ও বিশ্ব রাজনীতিতে কেন গুরুত্বপূর্ণ এই পাকিস্তান আর তার নির্বাচন? প্রতিবেশী ভারতের কট্টরতম প্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের সঙ্গে সীমান্ত রয়েছে ইরান আর তালেবান নিয়ন্ত্রিত আফগানিস্তানের, যেখানে পরিস্থিতি প্রায়ই গড়ায় সহিংস অস্থিরতার দিকে। বিশ্ব রাজনীতিতে সবচেয়ে প্রভাবশালী যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাকিস্তানের কখনও বন্ধুত্ব, কখনও বৈরিতার সম্পর্ক। যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম কট্টর প্রতিদ্বন্দ্বী চীন আবার পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ মিত্র। সবমিলিয়ে পরাশক্তিধর পাকিস্তানে ক্ষমতায় যে দলই থাকুক না কেন, তা গুরুত্বপূর্ণ শত্রু-মিত্র সব দেশের জন্যই। তবে আঞ্চলিক শান্তি, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার জন্য সবচেয়ে প্রত্যাশিত একটি স্থিতিশীল সরকার ব্যবস্থা।
কিন্তু নির্বাচনের দৌড়ে এগিয়ে থাকা দল, দলপ্রধান ও প্রধানমন্ত্রী প্রার্থীদের দিকে তাকালে আভাস মেলে, স্থিতিশীল দেশ এখনও বেশ দূরের গন্তব্য সাধারণ পাকিস্তানিদের জন্য।
তিনবারের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফ ২০১৮ সালের নির্বাচনে দাঁড়াতে পারেননি, দুর্নীতির দায়ে জেল এবং নির্বাচনে অংশগ্রহণে নিষেধাজ্ঞার কারণে। দণ্ডপ্রাপ্ত অবস্থায় চিকিৎসার কারণ দেখিয়ে কারাগার থেকে সোজা লন্ডনে চলে গিয়ে স্বেচ্ছা নির্বাসন নেন তিনি। লন্ডনে যে বিলাসবহুল কোটি পাউন্ডের অ্যাপার্টমেন্টের মালিকানা কেলেঙ্কারির দায়ে সাজাপ্রাপ্ত ছিলেন, ছয় বছর সেই ফ্ল্যাটে থেকেই দেশে ফিরেছেন নওয়াজ। তার অবর্তমানে দল পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজের নেতৃত্বে ছিলেন ভাই শাহবাজ শরীফ। ২০২২ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর শাহবাজ প্রধানমন্ত্রী হলে ঠিক নির্বাচনের আগে প্রত্যাবর্তন ঘটে ৭৪ বছর বয়সী নওয়াজের। গেলো দু'মাসে নওয়াজকে সব ধরনের অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে এবং রাজনীতিতে তার ওপর আজীবন নিষেধাজ্ঞাও অসাংবিধানিক বিবেচনায় বাতিল করা হয়েছে।
পাকিস্তানের রাজনীতিতে জোর গুঞ্জন- ইমরানের পতনের পর দেশের সেনাবাহিনী আর বিচার বিভাগের সমর্থন আদায় করেছেন নওয়াজ। এভাবেই চতুর্থ মেয়াদে নিজের প্রধানমন্ত্রিত্বের পথ সুগম করেছেন তিনি। সেনাবাহিনীর মত বদলের কৌশল নওয়াজের ভালোই রপ্ত করা আছে বলেও রয়েছে জনমত। ২০১৩ সালে তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ করে ফেলেছিলেন বলেই তাকে বিদায় নিতে হয়েছিল- রয়েছে এমন মতবাদও। ১৯৯৯ সালে সামরিক অভ্যুত্থানে তার দ্বিতীয় মেয়াদও ছিল ক্ষণস্থায়ী।
অন্যদিকে, বিশ্বনন্দিত ক্রিকেটার হিসেবে খেলার মাঠ থেকে রাজনীতির মাঠে এসেই ছক্কা পিটিয়েছিলেন ইমরান খান। যে কারণে নওয়াজ ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশ নিতে পারেননি, সেই একই কারণে এবারের নির্বাচনে থাকছেন না ইমরান। দুর্নীতিসহ অসংখ্য মামলায় এরই মধ্যে কয়েক দশকের কারাদণ্ড পাওয়া সাবেক এ প্রধানমন্ত্রী বর্তমানে জেলে, রয়েছে নির্বাচনে অংশ নেয়ায় নিষেধাজ্ঞাও। বর্তমানে ৭১ বছর বয়সী ইমরান দুই বছরেরও কম সময়ের ব্যবধানে সরকারপ্রধানের আসন থেকে সোজা গেছেন জেলে। রাজনীতিতে উত্থান হতে না হতেই তার এ পতনের নেপথ্যেও পাকিস্তানের সেনাবাহিনীই আছে বলে ধারণা করা হয়।
২০১৮'র নির্বাচনে পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের এ নেতা বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছিলেন দিনবদলের আশা দেখিয়ে, পারিবারিক ও স্বজনপ্রীতির রাজনীতির অবসান, দুর্নীতি দমন, বিচার বিভাগ সংস্কার এবং তরুণদের জন্য নতুন কর্মক্ষেত্র তৈরির মাধ্যমে অর্থনীতি গতিশীল করার আশ্বাস দিয়ে। কিন্তু জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধিসহ অর্থনীতিতে ধস, রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের কারাগারে পাঠানো, বাকস্বাধীনতা দমন, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও সাংবাদিকদের ওপর হামলার মতো অসংখ্য অভিযোগে নিজ শাসনামলেই বিদ্ধ হন তিনি। তবে সবচেয়ে বেশি সমালোচিত হয়েছেন পাকিস্তানি তালেবানের সঙ্গে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর না করে এবং আফগানিস্তানে তালেবানের শাসনে সমর্থন দিয়ে।
এছাড়া পাকিস্তানে নারীদের প্রতি সহিংসতায় সমর্থন আর আফগানিস্তানে নারীশিক্ষার অধিকার প্রত্যাখ্যান করেও বিশ্বজুড়ে হয়েছেন নিন্দিত।
এছাড়া আছেন পাকিস্তানের বিগত নির্বাচনে তৃতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করা দল পাকিস্তান পিপল'স পার্টির চেয়ারম্যান বিলাওয়াল ভুট্টো-জারদারি। মাত্র ৩৫ বছর বয়সী এ নেতা অভিজ্ঞতায় নবীন হলেও নামের শেষে থাকা পদবী ভুট্টো মা বেনজিরের এবং জারদারি বাবা আসিফ আলির। মা সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং বাবা সাবেক প্রেসিডেন্ট বলে পাকিস্তানিদের কাছে একেবারেই নতুন কেউ নন বিলাওয়াল। তাই পাকিস্তানের বংশ পরম্পরার রাজনীতিতে তার উত্থানও অপ্রত্যাশিত কিছু নয়।
পার্লামেন্টে আস্থা ভোটে হেরে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের পতনের পর পাকিস্তানের জোট সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন বিলাওয়াল। সরকারি ব্যয় এবং ধনীদের জন্য ভর্তুকিতে কাটছাঁট করে বেতন-মজুরি দ্বিগুণ করার আশ্বাস দিয়ে এবারের নির্বাচনী দৌড়ে এগিয়েছেন তিনি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই তিন নেতার যারই জয় হোক না কেন, ক্ষমতায় আসার পর দীর্ঘ কাজের তালিকা অপেক্ষা করছে তার জন্য। গোলমেলে রাজনীতি, আকাশচুম্বী মূল্যস্ফীতি, ধসে পড়া অর্থনীতি আর ক্রমশ নিম্নমুখী নিরাপত্তা পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য হাসফাঁস করছে পাকিস্তানের জনতা।