ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিশ্বে, সবকিছুর দাম হিসেব হয় ডলারে। তার রাজনীতিতে সহানুভূতির জায়গা নেই। ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চল কে নিয়ন্ত্রণ করছে, তা নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই ট্রাম্পের, যদি দেশের রেয়ার আর্থ মিনারেলের নিয়ন্ত্রণ তার হাতে থাকে। যেই যুদ্ধবিরতি চুক্তির আলোচনা তিনি করেছেন, তাতে অংশগ্রহণ নেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের, এমনকি যে দেশে যুদ্ধ চলছে সেই দেশের রাষ্ট্রপ্রধানকে বাদ দিয়ে যুদ্ধবিরতি নিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে ইতিবাচক আলোচনা শেষ করে ফেলেছেন তিনি।
যদিও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি স্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন, এমন কোন শান্তিচুক্তি গ্রহণ করা হবে না, যেখানে কিয়েভের অংশগ্রহণ নেই। ভ্লাদিমির পুতিনের পরিকল্পনা অনুযায়ী, কোনো চুক্তি হতে দেয়া যাবে না। ডোনাল্ড ট্রাম্প ইউক্রেনের স্বার্থেই কাজ করবে, এখনও এই বিশ্বাস রাখতে চান তিনি।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেন, ‘পুতিন ট্রাম্পের সঙ্গে আলোচনা করে তার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে চাইছেন। কিন্তু স্বায়ত্বশাসিত দেশ নিয়ে কোন সিদ্ধান্ত কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা না বলে তারা নিতে পারে না। ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বলেছি, নিরাপত্তা আমাদের কতো প্রয়োজন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রই চায় না আমরা ন্যাটোর সদস্য হই। এখনও বিশ্বাস করতে চাই, যুক্তরাষ্ট্র আমাদের সমর্থন করবে।’
এদিকে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে ভ্লাদিমির পুতিনের ফোনালাপের পর চটে গেছে পুরো ইউরোপীয় ইউনিয়ন। জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শোলজ বলেছেন, ইউক্রেনে অন্যের নিয়ন্ত্রণ করা শান্তিচুক্তি ইইউ কোনোভাবেই সমর্থন করে না। ইইউ পররাষ্ট্রনীতি প্রধান কাজা কাল্লাস বলেছেন, ইউক্রেন যুদ্ধবিরতি চুক্তি না করতে চাইলেও ইউরোপ পাশে আছে। ন্যাটো সদস্য দেশ ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার বলেছেন, যেকোনো শান্তি আলোচনার জন্য ইউক্রেনকে মধ্যমণি হিসেবে রাখতেই হবে।
জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শোলজ বলেন, ‘ইউক্রেনের মানুষ ছাড়া দেশ নিয়ে কোন সিদ্ধান্ত কিংবা ইউরোপিয়ানদের অংশগ্রহণ ছাড়া ইউরোপ নিয়ে কোন সিদ্ধান্ত হতে পারে না। ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত হয় এমন শান্তিচুক্তি করতে হবে। ইউরোপ আর যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা নষ্ট হয়, এমন চুক্তিকে আমরা সমর্থন করি না। এই চুক্তিতে একজনেরই উপকার হবে, ভ্লাদিমির পুতিনের। রাশিয়ার জয় আর ইউক্রেনের পরাজয় দিয়ে শান্তি আসবে না। নিশ্চিত করতে হবে ইউরোপে যেন আরেকটি যুদ্ধ না লাগে।’
এই ফোনালাপের পর যেন পুতিনের শর্তই ইউক্রেনের দিকে নতুন করে ছুড়ে দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আর প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ। বলেন, যুদ্ধবিরতি চুক্তির মধ্য দিয়ে ইউক্রেনকে ২০১৪ সালের পর দখল হওয়া ভূখণ্ডের মায় ছাড়তে হবে। ন্যাটোতে যোগদানের স্বপ্নও বিসর্জন দিতে হবে। ইউরোপ আর ইউক্রেনের কড়া জবাবের পর ট্রাম্প বলেন, রাশিয়ার সঙ্গে শান্তি আলোচনায় অবশ্যই অংশ নেবে ইউক্রেন। হোয়াইট হাউসে এক বক্তব্যে তিনি বলেন, যুদ্ধবিরতি আলোচনার অংশ কিয়েভ। কিন্তু এই আলোচনা কবে হবে, তা এখনই অনুমান করা মুশকিল বলে জানান ট্রাম্প। আবারো বলেন, ইউক্রেনের জন্য ইউরোপের বেশি সহায়তা দেয়া উচিত।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, ‘ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ন্যাটোর সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। বাস্তবতা হচ্ছে, ইউরোপের চেয়ে অনেক বেশি সহায়তা ইউক্রেনকে আমরা দিয়েছি। পুতিনের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে, জেলেনস্কির সঙ্গেও হবে। এই যুদ্ধ বন্ধের একটা চুক্তিতে আশা করি পৌঁছাতে পারবো। কিন্তু ইউক্রেনের ন্যাটোতে যোগদান রাশিয়া মেনে নেবে না। তাই এটা সম্ভবও না। কিন্তু অবশ্যই জেলেনস্কির সঙ্গে আলোচনা হবে।’
একই মত যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথেরও। যদিও ন্যাটো প্রধান বলছেন, ইউরোপ আর যুক্তরাষ্ট্র একজোট, এই বাস্তবতা রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে বোঝানো প্রয়োজন। সেজন্য শান্তি চুক্তির পাশাপাশি কিয়েভকে প্রয়োজনীয় সহায়তা দিয়ে যাওয়া উচিত। কিন্তু আবারও বলে দেন, শান্তিচুক্তির মধ্য দিয়ে ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্যপদ দেয়া হবে, এই কথা কখনও বলা হয়নি।
ন্যাটো প্রধান মার্ক রুট বলেন, ‘পুতিনকে বুঝতে হবে পশ্চিমারা একজোট হয়ে ইউক্রেনের পাশে আছে। এমন কোন সমাধানে আসতে হবে যেটা চিরস্থায়ী। পুতিন আলোচনায় বেশ ভালো কিন্তু বিশ্বাস করার মতো না। যুদ্ধবিরতি চাইলে দুইপক্ষকে নিয়ে চুক্তি করতে হবে। ন্যাটো ইউক্রেনকে নিরাপত্তা দেবে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ন্যাটোর সদস্যপদ দেয়া হবে, এই কথা বলা হয়নি।’
বিশ্লেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রে নেতৃত্বের পরিবর্তনে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন আবারো ফিরছেন আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে। ইউরোপের একটি দেশে যুদ্ধবিরতি আলোচনা ট্রাম্প ইইউকে ছাড়াই সেরে ফেলায় এই মহাদেশ আর যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে চির ধরার আশঙ্কাও করা হচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, ট্রাম্পের আমেরিকা ফার্স্ট নীতিতে ইউক্রেন বিক্রি হয়ে যাবে।
ছাতাম হাউজের হেড অব ইউরোপ প্রোগ্রাম অ্যাডমিরাল ভ্যান রিজ বলেন, ‘যদি এমন কোন শান্তিচুক্তি হয়, যা পুতিনের পক্ষে যায়, তার শর্তের সবটাই তিনি বাস্তবায়ন করবেন। ইউরোপের পূর্বাঞ্চল থেকে মার্কিন সেনাদের বের করবেন। কিন্তু সেটা ইউরোপের জন্য ভালো হবে না। কল্পনা করতেই পারছি, যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে বিক্রি করে দিচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বিরোধিতা করলেও তাদের দৃশ্যমান কোন পরিকল্পনা কিংবা পদক্ষেপ নেই ইউক্রেনকে নিয়ে।’
উত্তেজনার এমন সময় আজ (শুক্রবার, ১৪ ফেব্রুয়ারি) জার্মানির মিউনিখে ইউক্রেনে যুদ্ধবিরতি নিয়ে মার্কিন প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা হবে রুশ প্রতিনিধি দলের। কিন্তু রাশিয়া–ইউক্রেন সংকট সমাধান এতো জলদি হবে না বলেই মনে করছেন সামরিক বিশ্লেষকরা।