২০০০ সালে ব্যারেন্ট সাগরে 'কে ওয়ান ফোর ওয়ান কুরস্ক' নিউক্লিয়ার সাবমেরিন দুর্ঘটনার কবলে পড়ে, যেখানে ছিলেন ১১৮ জন নাবিক। সাবমেরিনটিতে দুটি বিস্ফোরণ হয়, যা তাৎক্ষণিকভাবে আমলে নেয়নি রুশ প্রশাসন। ক্ষমতায় আসা পুতিন ছিলেন অবকাশ যাপনে। কিছুদিন পর ব্রিটিশ আর নরওয়ের ডুবুরিরা সেই সাবমেরিন খুঁজে পেলেও জীবিত পাওয়া যায়নি কাউকে। সেই ঘটনায় বেশ তোলপাড় হয়েছিলো আন্তর্জাতিক অঙ্গন। চরম সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়েছিলো পুতিনকে। ২৪ বছর পর ২০২৪ সালে এসে আবার সেই কুরস্ক নিয়ে উত্তেজনা। যদিও এবারের প্রেক্ষাপট কিছুটা ভিন্ন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই প্রথম ইউক্রেনীয় সেনারা কুরস্কে অনুপ্রবেশ করেছে।
শুধু কুরস্ক নয়, ইউক্রেনে সেনা অভিযান শুরুর পর ঘটেছে আরও অনেক ঘটনা। ২০২২ সালে রুশ নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ মস্কোভা কৃষ্ণ সাগরে ডুবিয়ে দেয় ইউক্রেন। ২০২৩ সালে রাশিয়ার ভাড়াটে বাহিনী ওয়াগনার গ্রুপের বিদ্রোহ আর মস্কো অভিমুখে যাত্রা, এসবে স্পষ্ট, চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে পুতিন প্রশাসন।
সংবাদ মাধ্যম বিবিসি'র প্রতিবেদন বলছে, কুরস্কে ইউক্রেনীয় সেনারা যতদিন থাকবে, পুতিন প্রশাসনের নেতৃত্ব আর ভাবমূর্তি ততো সংকটের মুখে পড়বে। তবে দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে পুতিন প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করে আসায় তিনি রাশিয়ার সাধারণ মানুষের কাছে তৈরি করেছেন 'মিস্টার সিকিউরিটি'র ইমেজ। ইউক্রেনে সেনা অভিযানকে সাধারণ মানুষের কাছে প্রতিষ্ঠা করেছেন দেশের নিরাপত্তা বাড়ানোর উদ্যোগ হিসেবে।
কিন্তু পরিস্থিতি বলছে ভিন্ন কথা। সুইডেন আর ফিনল্যান্ড উত্তর আটলান্টিক প্রতিরক্ষা জোট ন্যাটোতে যুক্ত হওয়ায় এখন রাশিয়ার সীমান্তে ন্যাটোর সদস্যদের উপস্থিতি বেশি। রাশিয়ার অনেক শহর ইউক্রেনের ড্রোন হামলার শিকার হচ্ছে। এখন আবার ইউক্রেনের সেনারা প্রবেশ করেছে রাশিয়ার সীমান্তবর্তী শহর কুরস্কে। এরপরও দেশের জনগণকে নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হতে নিষেধ করছেন পুতিন। সেনা অভিযানকে নাম দিয়েছেন অনুপ্রবেশ। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে এরপর কি করবেন রুশ প্রেসিডেন্ট?
সংবাদ মাধ্যম বিবিসি বলছে, রাশিয়া কোনদিনই শান্তি আলোচনায় যাবে না। কুরস্কে সেনা সক্ষমতা না বাড়িয়ে এই এলাকা পুনর্দখলের চেষ্টা চালাচ্ছেন পুতিন। ইউক্রেনে সেনা অভিযান নিয়ে কোন অনুতাপও নেই তার। বিশ্লেষকরা বলছেন, কুরস্কে ইউক্রেনের সেনা অনুপ্রবেশের ঘটনা ভ্লাদিমির পুতিনের জন্য অপমানজনক। কারণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর প্রথমবারের মতো সেনা অভিযান চালানো হয়েছে রাশিয়ায়।
অবসরপ্রাপ্ত ব্রিটিশ রয়্যাল নেভি কর্মকর্তা ক্রিস্টোফার পেরি বলেন, ‘কিন্তু পুতিন যেটা বলে সেটা করে। সে পরমাণু হামলার হুমকি দিয়েছিলো, কিন্তু নিজের দেশে পরমাণু হামলা করতে পারবে না । ইউক্রেনকে তারা ভিন্ন ভূখন্ড মনেই করে না, নিজেদের অংশ মনে করে। এটাকে তারা সন্ত্রাসী হামলা বলছে । অথচ ইউক্রেনে সেনা অভিযানে একই কাজ করেছে রাশিয়া।’
সংবাদ মাধ্যম আরটির বিশ্লেষণ বলছে, সারাবিশ্বে ভেঙে পড়েছে একসময়ের তৈরি করা অঘোষিত সামরিক আইন। বহির্বিশ্ব এখনও জানে না আসলে কি হচ্ছে ইউক্রেন আর রাশিয়ার মধ্যে। বিশ্লেষকদের অনুমান বলছে, ইউরোপে রাশিয়ার গ্যাস সরবরাহ ব্যাহত করতেই কুরস্কে অভিযান চালিয়েছে কিয়েভ। কুরস্কের সুধজা শহরে গ্যাস স্টেশন থাকায় কোনভাবে এই ভাল্ব বন্ধ করতে পারলে বন্ধ হয়ে যাবে গ্যাস সরবরাহ।
সংবাদ মাধ্যম আরটির বিশ্লেষণ আরও বলছে, ইউক্রেনকে রাশিয়ার অংশ বিবেচনা করে এই দেশে সেনা অভিযানের জন্য ভ্লাদিমির পুতিনের বিচার নিয়ে ভলোদিমির জেলেনস্কির দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট। এই অভিযানের আগে পশ্চিমাদের অনুমতি নেয়নি ইউক্রেন প্রশাসন। এখানেই স্পষ্ট যে, পশ্চিমাদের পুরনো অঘোষিত সামরিক নীতি অনুসরণ করছে না ইউক্রেন। পুরনো সেই নীতিতে পশ্চিমারা আগ্রাসন চায়নি, তারা চেয়েছিলো, ইউক্রেন নিজেদের ভূখন্ড রক্ষা করুক, যে কারণে কিয়েভকে সামরিক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন আর যুক্তরাষ্ট্র। কুরস্কে ইউক্রেনের আকস্মিক এই অনুপ্রবেশ বলে দিচ্ছে, ভেঙে যাচ্ছে পুরনো অঘোষিত পশ্চিমা নীতি, ফলে ক্রমেই পরিস্থিতি চলে যাচ্ছে নিয়ন্ত্রণের বাইরে।