মাইনাস ৩০ ডিগ্রিতে খালি গায়ে বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখা কিংবা বরফের পানিতে ডোবানো। এমন সব শাস্তি দেয়ার অভিযোগ রয়েছে সাইবেরিয়ার কুখ্যাত আইকে-থ্রি কারাগারে। সেখানেই ছিলেন রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনবিরোধী নেতা অ্যালেক্সি নাভালনি। সমাজ ও সভ্যতা থেকে বিচ্ছিন্ন ওই কারাগারেই হঠাৎ মারা যান তিনি।
১৯৬১ সালে উত্তর মেরুর সাইবেরিয়া অঞ্চলে গড়ে তোলা হয় কুখ্যাত কারাগার আইকে-থ্রি। যা পোলার উলফ নামেও পরিচিত। জনমানবশূন্য এই এলাকায় সভ্যতার আলো পৌঁছায়নি। শীতকালে সেখানে তাপমাত্রা নামে মাইনাস ৩০ ডিগ্রিতে। কোনো সাধারণ দর্শনার্থীর পক্ষে সেখানে যাওয়া প্রায় অসম্ভব। ষাটের দশক থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নের রাজনৈতিক বিরোধী ও কুখ্যাত সব আসামিদের এই কারাগারে রাখা হতো।
কারাগারে নিয়মের সামান্য ব্যত্যয় ঘটলেই বন্দীদের কঠিন শাস্তির কথা প্রচলিত রয়েছে। কখনও কনকনে শীতে জ্যাকেট ছাড়া কিংবা বরফের পানিতে বন্দিদের রাখার অভিযোগও শোনা যায়।
আইকে-থ্রি কারাগার ভয়ানক অপরাধীদের জন্য হলেও বিরোধীদলীয় নেতা অ্যালেক্সি নাভালনিরও ঠাঁই হয় সেখানে। উগ্রপন্থি সংগঠনে অর্থায়ন ও তাদের উস্কানি দেয়ার অভিযোগে তাকে ১৯ বছরের জেল দেয় ক্রেমলিন। গত আগস্ট থেকে ওই কারাগারে বন্দি ছিলেন পুতিনের কট্টর সমালোচক নাভালনি।
গত ডিসেম্বরে তার রহস্যজনক মৃত্যুর গুজব ছড়ায়। অভিযোগ ওঠে তাকে গুম করে মেরে ফেলেছে রুশ সরকার। পরে জানা যায়, তাকে সাইবেরিয়ার কুখ্যাত পোলার উলফ কারাগারে রাখা হয়েছে। এর আগে দুই বছর জেল খেটেছেন মস্কো থেকে চার ঘণ্টার দূরত্বের মেলেখভো কলোনিতে। ২০১৭ সালে এক আন্দোলনে আততায়ীর ছোড়া রাসায়ানিক গ্যাসে তার এক চোখের দৃষ্টিশক্তি ৮০ ভাগ চলে যায়। ২০২০ সালে তাকে হত্যাচেষ্টায় বিষপ্রয়োগেরও অভিযোগ পাওয়া যায়। কারাগারে থাকা অবস্থায় পেট ও পিঠের সমস্যায় ভুগছিলেন তিনি।
কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক টিমোথি ফ্রেই বলেন, জেলে তার সঙ্গে যে আচরণ করা হয়েছে, তা সত্যিই দুঃখজনক। ৪৭ বছর বয়সে এমন অত্যাচার সহ্য করে সুস্থ থাকা অসম্ভব। তাকে বিষক্রিয়ায় হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল। সে বেঁচে থাকলে রাশিয়াকে নতুনভাবে নেতৃত্ব দিতো। আজকের এই অবস্থার জন্য রুশ সরকার দায়ী।
গত মাসে আইকে-থ্রি কারাগারের ভেতরের অবস্থা নিজেই বর্ণনা করেন নাভালনি। ভোর ৫টায় বন্দিদের দিয়ে জাতীয় সংগীতের পর গাওয়ানো হয় পুতিনের প্রিয় গান 'আমি রাশিয়ান'। মেলেখভো থেকে প্রায় দুই হাজার কিলোমিটার দূরে খার্পে শহরের ২০ দিনের অসহনীয় যাত্রার বর্ণনা দেন ব্যাঙ্গাত্মকভাবে। কারাগারে নিঃসঙ্গ ছিলেন নাভালনি। সাইবেরিয়ার ওই অঞ্চলের রাস্তাঘাট মাসের পর মাস একটানা বরফে ঢাকা থাকে।
গেল শুক্রবার হঠাৎ তার মৃত্যুর খবর দেয় ক্রেমলিন। রুশ কারা কর্তৃপক্ষ তার মাকে জানায়, নাভালনির মৃত্যুর কারণ 'সাডেন ডেথ সিন্ড্রোম'। যার কোনো লক্ষণ ও কারণ জানা যায় না। আগের দিন কারাগার থেকে হাসিমুখে আদালতের শুনানিতে ভার্চুয়ালি যোগ দেন তিনি। মজার ছলে কথা বলেন সবার সঙ্গে। শুনানির পর ওইদিনই জেল কর্তৃপক্ষ দাবি করে- হাঁটতে হাঁটতে হুট করে পড়ে গিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন নাভালনি। এরপর নানা পরীক্ষা-নিরিক্ষার পর ৪৭ বছর বয়সী এই নেতা আর বেঁচে নেই বলে জানান চিকিৎসকরা।
তার এমন মৃত্যু নিয়ে গোটা বিশ্বেই আলোচনা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্র দেশগুলো নাভালনির মৃত্যুর পেছনে পুতিনকেই দায়ী করছে। তাকে কৌশলে হত্যা করা হয়েছে বলেও দাবি তুলেছে নাভালনির পরিবার ও তার সমর্থকরা। নাভালনিকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে রাশিয়ার বিভিন্ন শহরে তার দলের চারশো’র বেশি কর্মী আটক হয়েছেন।