প্রযুক্তি সংবাদ
তথ্য-প্রযুক্তি
0

তথ্য নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আন্তর্জাতিক বিবাদের বলি পাভেল দুরোভ

প্রযুক্তি অঙ্গনে সমালোচনার ঝড়

ফ্রান্সে টেলিগ্রাম-প্রধানকে গ্রেপ্তার ইস্যুতে সমালোচনার ঝড় বয়ে যাচ্ছে আন্তর্জাতিক প্রযুক্তি অঙ্গন থেকে শুরু করে বিশ্ব রাজনীতিতেও। অভিযোগ উঠেছে, তথ্য নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আন্তর্জাতিক বিবাদের বলি হয়েছেন পাভেল দুরোভ। বিভিন্ন দেশের সরকারের সঙ্গে টেলিগ্রামের যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতাই দুরোভকে গ্রেপ্তারের কারণ, বলছেন বিশ্লেষকরা।

দুবাইভিত্তিক বহুজাতিক মেসেজিং অ্যাপ টেলিগ্রামের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী পাভেল দুরোভ ফ্রান্সে গ্রেপ্তার হন গেলো সপ্তাহে। আজারবাইজান থেকে প্যারিস বিমানবন্দরে অবতরণমাত্রই তাকে হেফাজতে নেয় পুলিশ।

৩৯ বছর বয়সী এই ধনকুবের চারদিন কারা হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ৫০ লাখ ইউরোর বিনিময়ে জামিন পেলেও ফ্রান্সত্যাগে নিষেধাজ্ঞা এবং সপ্তাহে দু'বার থানায় হাজিরা দেয়ার আদেশ পেয়েছেন।

ফরাসি গোয়েন্দাদের অভিযোগ, প্রায় একশো কোটি সক্রিয় ব্যবহারকারীর প্লাটফর্ম টেলিগ্রামে সন্ত্রাসী আর মাদক পাচারকারীদের রয়েছে অবাধ পদচারণা।

ফ্রান্সে বহুল ব্যবহৃত এই মেসেজিং অ্যাপটি ব্যবহার করেন ফরাসি প্রেসিডেন্সিয়াল প্যালেস আর মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারাও, মূলত যেখান থেকেই পাভেল দুরোভের বিরুদ্ধে তদন্তের সূত্রপাত। অর্থপাচার, আর শিশুদের যৌন নিগ্রহের ছবি ছড়ানোর সঙ্গে সম্পৃক্ততারও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

ফরাসি প্রশাসন বলছে, আইন অনুযায়ী এসব অপরাধী কার্যকলাপের তথ্য ও নথি কর্তৃপক্ষকে দেয়া বাধ্যতামূলক হলেও এতে রাজি হননি দুরোভ।

তার আইনজীবীদের দাবি, অ্যাপে সংঘটিত অপরাধের দায় কিছুতেই দুরোভের হতে পারে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিভিন্ন দেশের সরকারের সঙ্গে টেলিগ্রামের যোগাযোগবিচ্ছিন্নতাই দুরোভকে গ্রেপ্তারের কারণ।

যুক্তরাষ্ট্রের টেক পলিসি কনসালটেন্সি অ্যাঙ্কর চেঞ্জের প্রধান নির্বাহী কেটি হারবাথ বলেন, ‘একে তো এসব তৎপরতা রুখতে টেলিগ্রাম কোনো পদক্ষেপ নেয়নি, তার ওপর কোনো সরকার বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গেও সম্পৃক্ত হয়। তাই কী ঘটছে, সে বিষয়ে জবাবদিহিতা নিশ্চিতে বাধ্য হয়েই তাকে গ্রেপ্তার করতে হয়েছে।’

টেলিগ্রাম অ্যাপের মাধ্যমে ব্যক্তিগত যোগাযোগ ও গ্রুপ চ্যাটের পাশাপাশি আছে বিপুলসংখ্যক সাবস্ক্রাইবার সমেত চ্যানেলের সুবিধা।প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মেটার হোয়াটসঅ্যাপে একটি গ্রুপে সর্বোচ্চ এক হাজার ২৪ জন ব্যবহারকারী থাকতে পারলেও টেলিগ্রাম গ্রুপে এ সংখ্যা দুই লাখ।

এতে ভুয়া তথ্য সহজে ছড়ায় বলে উদ্বেগ বিশেষজ্ঞদের। যদিও পাভেল দুরোভের নিজ দেশের বাসিন্দাদের অভিযোগ, তথ্য নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আন্তর্জাতিক বিবাদের বলি হয়েছেন এই উদ্যোক্তা।

এক অধিবাসী বলেন, ‘এটা রাজনীতি। ফ্রান্সে তারা একজন রুশ ধনকুবেরকে গ্রেপ্তার করেছে। কারণ, এতেই তাদের লাভ, রাশিয়ার ক্ষতি।’

অরেক অধিবাসী বলেন, ‘অন্যপক্ষকে তথ্য না দিয়ে দুরোভ তো খুব অন্যায় কিছু করেননি। তাও দিনশেষে সব চাবি শত্রু দেশকে দিয়ে দিতে বাধ্য হওয়ার মতো পরিস্থিতিতে পড়েছেন তিনি। রাশিয়াকে যা দেননি, তা এখন ইউরোপকে দিয়ে দিতে হচ্ছে।’

জন্মসূত্রে রুশ পাভেল দুরোভের রয়েছে ফ্রান্স-সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ চারটি দেশের নাগরিকত্ব। ২০২৩ সালে ফোর্বস বিলিয়নিয়ার্স তালিকাভুক্ত হওয়া দুরোভের সম্পদের পরিমাণ এক হাজার কোটি ডলারের বেশি।

২০১৩ সালে ভাই নিকোলাইয়ের সঙ্গে যৌথভাবে টেলিগ্রাম চালু করেন দুরোভ। টেলিগ্রামের তথ্য, অ্যাপটির পেছনে প্রযুক্তিগত অবদান নিকোইলাইয়ের এবং আর্থিক ও মতাদর্শগত সহায়তা পাভেল দুরোভের।

শীর্ষ কোনো মেসেজিং প্ল্যাটফর্মের প্রধান নির্বাহী হিসেবে দুরোভের গ্রেপ্তার বিশ্বে প্রথম। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়া জায়ান্টদের সঙ্গে বিভিন্ন দেশের সরকারের বিবাদ নতুন নয়; নতুন নয় পুলিশ আর বিচার ব্যবস্থার সঙ্গে টেলিগ্রামের দ্বন্দ্বও।

যুক্তরাজ্য, জার্মানি, স্পেন, নরওয়ে, রাশিয়া, বেলারুশ, চীন, ইরান, ভারত, থাইল্যান্ড, ব্রাজিলসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে নিষিদ্ধ ছিল টেলিগ্রাম। এ পাভেল দুরোভের গ্রেপ্তার ও আইনি হয়রানির বিরুদ্ধে ক্ষোভ জানিয়েছেন ইলোন মাস্কসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তারা। প্যারিসের আদালতের সিদ্ধান্তকে হঠকারী বলছেন খোদ ফরাসি আইনজীবীরাই।

ফ্রান্সের আইনজীবি রবিন বিনসার্ড বলেন, ‘রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থেকে গ্রাহকদের যোগাযোগের পথ করে দেয়ার মাধ্যমে তাদের অপরাধের সুযোগ করে দিচ্ছে টেলিগ্রাম, এমনটা ধরে নিয়েছেন প্যারিস আদালত। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, এটা হঠকারী যুক্তি। প্লাটফর্মের অপরাধীদের পরিকল্পনা জেনে তাতে সহযোগিতা করলে শাস্তিযোগ্য হবেন টেলিগ্রামপ্রধান। কিন্তু আদতে ঘটনা তা নয়।’

টেলিগ্রামের আগে রাশিয়ার সর্ববৃহৎ সোশ্যাল নেটওয়ার্ক ভিকোনতাক্তে প্রতিষ্ঠিত হয় দুরোভের হাত ধরে। ২০১১-১২ সালে মস্কোতে গণতন্ত্রপন্থিদের গণবিক্ষোভকে কেন্দ্র করে রুশ সরকারের ব্যাপক দমনপীড়নের সময় চাপে পড়ে ভিকোনতাক্তে।

দুরোভের তথ্য অনুযায়ী, সে সময় অনলাইনে বিরোধী মতাদর্শ প্রচার নিষিদ্ধের নির্দেশ দিয়েছিল মস্কো। পরে ২০১৩ সালে প্রতিবেশী ইউক্রেনে যে অভ্যুত্থানের জেরে ক্ষমতাচ্যুত হন রুশপন্থি প্রেসিডেন্ট, সেই অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারীদের ব্যক্তিগত তথ্যও হস্তান্তরের নির্দেশ দেয়া হয় দুরোভকে। রুশ কর্তৃপক্ষের চাপের মুখে ২০১৪ সালে ভিকোনতাক্তেতে নিজের মালিকানা বিক্রি করে রাশিয়া ছাড়েন দুরোভ।

tech

এই সম্পর্কিত অন্যান্য খবর