ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসন শুরু হওয়ার পর থেকে গোটা বিশ্বে সৃষ্টি হয়েছে বিভক্তি। চলছে কথার লড়াইও। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপসহ পৃথিবীর নানা প্রান্তে সরাসরি সংঘাতে জড়াচ্ছে ইসরাইল ও ফিলিস্তিনপন্থীরা। আলোচনার টেবিলে সন্ত্রাসবাদ, ইহুদী বিদ্বেষ, দ্বিরাষ্ট্র নীতির মতো নানা বিষয়। তবে, রাজপথ ছাপিয়ে এই দুই পক্ষের মধ্যে আরেকটি সমান্তরাল দ্বন্দ্ব চলছে সামাজিক মাধ্যমগুলোতে। আর সেখানে ইসরাইলের হয়ে লড়াই করছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির চ্যাটবট।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্ত্বা বা এআইয়ের যুগে 'চ্যাটবটে'র সাথে সকলেই কমবেশি পরিচিত। চ্যাটবট মূলত একটি কম্পিউটার প্রোগ্রাম যা মানুষের কথোপকথন অনুকরণ করতে পারে। এক বা একাধিক মানুষের সাথে বুদ্ধিদীপ্ত আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার সক্ষমতা আছে এই প্রোগ্রামটির।
গেল বছরের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর থেকে সামাজিক মাধ্যমে চ্যাটবটের সন্দেহজনক গতিবিধি টের পান সাইবার বিশেষজ্ঞরা। আর তখনই ইসরাইল নিয়ন্ত্রিত চ্যাটবটের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণের কাজ শুরু করেন লেবাননভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ইনফ্লুয়ে-আন্সার্সের দুই গবেষক রালফ বেডোউন ও মিচেল সেম্যান।
রালফ ও মিচেলের গবেষণা বলছে, হামাস-ইসরাইল সংঘাতের শুরুতে ফিলিস্তিনপন্থী সমর্থকদের পোস্ট বা ভিডিও সংখ্যা বেশি চোখে পড়লেও, কমেন্ট সেকশনে ইসরাইলপন্থীদের উপস্থিতি ছিল অস্বাভাবিকরকম বেশি। গাজা ইস্যুতে কোনো কন্টেন্ট প্রকাশের ৫ থেকে ১০ মিনিটের মধ্যেই কমেন্ট বক্স ভরে যায় ইসরাইলপন্থীদের প্রতিবাদে।
তবে, অধিকাংশ টুইট বা ফেসবুক কমেন্টে ইসরাইলি সমর্থকদের প্রতিবাদের ভাষা, কমেন্ট করার প্যাটার্ন একইরকম। যদিও সেটা মানুষ না চ্যাটবটের কমেন্ট তা বোঝা খুবই দুষ্কর। রালফ ও মিচেল জোর দিয়ে বলছেন এগুলো এআই নির্ভর চ্যাটবটের কাজ।
ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের হাজারটা সমস্যার সমাধান করতে পারে চ্যাটবট। খুব সহজে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহসহ অনলাইন প্রতিষ্ঠানে গ্রাহকসেবা দেয়ার মতো কাজ অনায়েসেই করতে পারে প্রোগ্রামটি। কিন্তু সামাজিক মাধ্যমে গুজব, প্রোপাগান্ডা ছড়াতে চ্যাটবটের ব্যবহার রীতিমতো আশঙ্কাজনক।
যুক্তরাষ্ট্রের সাইবার নিরাপত্তা বিষয়ক প্রতিষ্ঠান ইমপার্ভার তথ্য বলছে, ২০২৩ এর শেষে ইন্টারনেট জগতের প্রায় অর্ধেকই চ্যাটবটের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। এসব চ্যাটবটের ৩৪ শতাংশই নানা ধরনের নীতি বিরুদ্ধ কাজে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। গ্রাহক সেবায় কাজ করছে মাত্র ১৫ শতাংশ চ্যাটবট। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্ত্বার জনপ্রিয়তাকে এর পেছনে দায়ী করছে ইমপার্ভা।
ইনফ্লুয়ে-আন্সার্সের গবেষণা প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ফিলিস্থিনের সমর্থনে সামাজিক মাধ্যমে কিছু পোস্ট করলে সেখানে কমেন্টের মাধ্যমে সন্দেহ ও বিভ্রান্তির সৃষ্টি করাই ইসরাইল নিয়ন্ত্রিত চ্যাটবটের কাজ। ইলেকট্রনিক ফ্রন্টিয়ার ফাউন্ডেশন বলছে, চ্যাটবটের প্রযুক্তি এতটাই উন্নত হয়েছে কমেন্ট যে এসব দেখে বোঝার উপায় নেই কাজটি মানুষের না রোবটের।
প্রথম ধাপে, সামাজিক মাধ্যমে একটি পোস্টের জনপ্রিয়তা, অর্থাৎ রিচ দেখে টার্গেট সনাক্ত করে ইসরাইলের এসব চ্যাটবট। হ্যাশট্যাগে গাজা যুদ্ধ, যুদ্ধবিরতি, গণহত্যা ইত্যাদি লেখা থাকলে চ্যাটবটের জন্য আরও সহজ হয় কাজটি।
এসব চ্যাটবটে আগে থেকেই পোস্টের কী ধরণের কমেন্ট করা হবে তার ইনপুট দেয়া থাকে। টার্গেট সনাক্তের পর দ্বিতীয়ধাপে সেই ইনপুট অনুসারে কাজ শুরু করে দেয় চ্যাটবট আর্মি।
তবে কিছু জিনিস খেয়াল করলে সামাজিক মাধ্যমে চ্যাটবট প্রোফাইল শনাক্ত করা সম্ভব। ফেসবুক বা টুইটার প্রোফাইলে এআই নির্মিত ছবি ও অসম্পূর্ণ তথ্য, একাউন্টের বয়স, অনুসারিদের সংখ্যা ও প্রোফাইলে একই ধরণের পোস্টের পুনরাবৃত্তি দেখলে বুঝতে হবে একাউন্টটি চ্যাটবট দিয়ে নিয়ন্ত্রিত।
ইউরোপের আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা ইউরোপোলের প্রতিবেদন বলছে ২০২৬ সাল নাগাদ অনলাইনের ৯০ শতাংশ কন্টেন্ট বা আধেয় নিয়ন্ত্রণ করবে এআই। তবে, বাক স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে অনেকেই সামাজিক মাধ্যম নজরদারির আওতায় আনার বিপক্ষে। যোগাযোগ বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, চ্যাটবটের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে বৈশ্বিক নানা ইস্যুতে ছড়াতে পারে গুজব, বাড়তে পারে জাতিগত বিদ্বেষ।