দেশে এখন
স্বাস্থ্য
0

ট্রান্সজেন্ডার-জন্মগত ত্রুটি 'ডিএসডি' নিয়ে বিভ্রান্তি

সমাজের নানা ট্যাবু ও অসচেতনতায় ট্রান্সজেন্ডার ও জন্মগত ত্রুটি ডিএসডি নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ায়। চিকিৎসকরা বলছেন, যৌনাঙ্গের জন্মগত ত্রুটির সার্জারি হলেও ডিস্ফোরিয়ার রোগীদের সুস্থতার পথ সার্জারি নয়।

জন্মের পর থেকে পরিবারে মেয়ে হিসেবে বড় হওয়া ইয়াসমিন ২৩ বছর পর আত্মপ্রকাশ করেন ইউসুফ হিসেবে। যৌনাঙ্গ দেখে নিশ্চিত হতে না পারায় মেয়ে হিসেবেই বড় হয় ইউসুফ। বয়ঃসন্ধিকালে ইউসুফ নিজে নিশ্চিত হলেও মানেনি পরিবার। বাধ্য হয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে ঢাকায় আসেন। দু'দফা সার্জারির পর বিয়েও করেন। জাতীয় পরিচয়পত্র পরিবর্তন করতে না পারায় এইচএসসি পাশ করা ইউসুফ সামান্য একটি চাকরি দিয়েই চালিয়ে নিচ্ছেন সংসার।

ইউসুফ বলেন, 'ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পর যখন দেখতেছি যে, কোনো কিছুতে কাজ হচ্ছে না। সেক্ষেত্রে আমি বাড়ি থেকে বের হয়ে  আসি।  আমি এ পর্যন্ত দুইটা সার্জারি করেছি আরও একটা করতে হবে। অস্বাভাবিক যন্ত্রণা অনুভব করেছি যে এই জীবন থেকে মুক্তি পাবো।'

যৌনাঙ্গে জন্মগত ত্রুটি নিয়ে অনেকেই এ ধরনের বিড়ম্বনায় পড়েন। লোকচক্ষুর ভয়ে ভুক্তভোগী নিজের সমস্যা পুরোপুরি বুঝলেও বাধ সাধে পরিবার, সমাজ। এছাড়াও চিকিৎসার সহজ সুযোগ না থাকায় অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে বড় হতে হয় অধিকাংশদেরই।

আরেকজন বলেন, 'মা ভুলক্রমে মেয়ে হিসেবে বড় করে। প্রথমে আমি আসলে কারো কাছে শেয়ার করব এমন কোনো উপায় ছিল না।'

আরেকজন বলেন, 'যখন বড় হয়েছি তখন আসলে ডাক্তার দেখিয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন হাসপাতালে নিয়ে গেছে। শেষ পর্যন্ত পিজি হাসপাতালে যাওয়ার পরে আমার সমস্যা সমাধান হইছে।'

একজন শিশু ভূক্তভোগীর মা বলেন, 'জন্মেছিল মেয়ে। তারপর দশ বারো দিন পরে সমস্যা হলো। পরে ডাক্তারের কাছে নিয়ে আসছি। ডাক্তার বল্লো যে, বাচ্চা তোমাদের ছেলেই হবে।'

লালমাটিয়া পেডিয়াট্রিক ইউরোলজি অ্যান্ড ডিএসডি সেন্টারের মেডিকেল অফিসার ডা. মনিকা ইসলাম বলেন, 'হরমোনাল টেস্ট  আছে, সোনোগ্রাফি, আলট্রাসনোগ্রাফি এবং ক্যারিওটাইপ করে জানা যায় সে আসলে ডিএসডির পেশেন্ট। সে ইন্টারনাল এবং জেনেটিক্যালি সে একজন ছেলে।'

এদিকে শারীরিকভাবে নারীর সব ধরনের বৈশিষ্ট থাকার পরও ছোট থেকেই পুরুষের মন নিয়ে বড় হয়েছে জোনাকি। নারীর পোশাক অসহ্য লাগলেও নারীদের প্রতি বিশেষ ফিলিংস জাগে জোনাকির। জেন্ডার ডিস্ফোরিয়া নামক মানসিক সমস্যার বিষয়টি নিজে বুঝলেও সমাধানের পথ না পেয়ে দিশেহারা সে।

জোনাকি বলেন, 'মেয়েদের কোনো কিছু ভালো লাগে না। ছেলেদের সাথে মিশতে ইচ্ছে করে না। মেয়ে ভালো লাগে প্রেম ভালোবাসার মতো একটা বিষয় ঐরকম ফিল হয়। শুরু থেকে চেষ্টা করেছ এইরকম যদি ডাক্তার পেতাম তাহলে ডাক্তারের সাথে কথা বলতাম যে  আমি ছেলে হতে চাই।'

সাউথ এশিয়ান সোসাইটি ফর সেক্সুয়াল মেডিসিনের প্রেসিডেন্ট ডা. মোহাম্মদ শামসুল আহসান মাকসুদ বলেন, 'পুরুষ থেকে নারীতে রুপান্তরিত হতে চান এই রকম একজন ট্রান্সজেন্ডার এদের মধ্যে শারীরিক কাঠামো, অর্ন্তগত কাঠামো কোনো তফাৎ নেই। তফাৎটা হচ্ছে তাদের মানসিক জায়গায় মস্তিষ্কে। তারা মনে করে যে তারা ভুল জেন্ডারে আছে। একইভাবে একজন নারী সে যদি পুরুষে রূপান্তরিত হতে চায় তাদেরকে আমরা বলি ট্র্যান্সমেন। তাদের নারীর যা যা বৈশিষ্ট্য থাকে একইরকম থাকে কিন্তু তারা নিজেদেরকে নারীর খাঁচায়  আবদ্ধ একজন পুরুষ মনে করে।'

সমস্যা সুনির্দিষ্ট হলেও সাধারণ মানুষ ট্রান্সজেন্ডার ও জন্মগত ত্রুটি ডিএসডি নিয়ে বিভ্রান্তিতে পড়েন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও লালমাটিয়ার একটি বেসরকারি হাসপাতালে যৌনাঙ্গের জন্মগত ত্রুটির সার্জারি হলেও ডিস্ফোরিয়ার রোগীদের সুস্থ হবার পথ সার্জারি নয় বলে মত লিঙ্গ নির্ধারণী বিশেষজ্ঞদের।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশু সার্জারি বিভাগের কনসালটেন্ট সার্জন ডা. মো. নজরুল ইসলাম আকাশ বলেন, 'চিকিৎস্যা হচ্ছে ছোটবেলা থেকেই তাদেরকে নার্সারি করতে হবে যে, যেই জেন্ডারে আছে সেই জেন্ডারে এবং সেভাবে রোল প্লে করতে হবে। তাদেরকে শিক্ষা দিতে হবে। সেটা ধর্মীয় জ্ঞান, সামাজিক জ্ঞান এবং তার পারিপার্শ্বিক জ্ঞান।  এরপর যদি কাজ না হয় তাহলে  আমরা সাইক্রিয়াটিস বিভাগে পাঠাই।'

তবে মাত্রাতিরিক্ত সমস্যাযুক্ত জেন্ডার ডিস্ফোরিয়ার রোগীরা দেশের বাইরে সার্জারি করে পুরুষ থেকে নারী বা নারী থেকে পুরুষ হয়ে গেলেও তারা কখনই সন্তান জন্মদানে সক্ষম হবেন না বলে দাবি বিশেষজ্ঞদের।

সার্জন আরও বলেন, পরে হরমোন নিল, সার্জারি করলো সে ছেলে থেকে মেয়ে হলো কিন্তু এই মেয়ে হওয়ায় ফাংশনাল কোনো লাভ নেই তার। সে এই রোল প্লেটা করতে পারে সেটা সার্জারি না করলেও। যেমন বেশভূষা, পোশাক। কিন্তু ছেলে থেকে মেয়ে হওয়ার পরেও সে কোনোদিন বাচ্চা জন্ম দিতে পারবে না।

জন্মের পর যে সব শিশুদের বাহ্যিক শারীরিক বৈশিষ্ট দেখে ছেলে কিংবা মেয়ে শনাক্ত কঠিন হয় বা বয়ঃসন্ধিকালে যদি সেক্সুয়াল বৈশিষ্টগুলো বিপরীতভাবে প্রকাশ পায় তাদেরকে শিশু সার্জন বা লিঙ্গ নির্ধারণী সার্জন বা শিশু হরমোন রোগ বিশেষজ্ঞ বা অন্তত একজন শিশু বিশেষজ্ঞের কাছে পাঠানোর পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।

ইএ