বাতের ব্যথার পরিচিতি ও জটিলতা
বাতের ব্যথা কোনো একক রোগ নয়, এর জটিলতা এর প্রকারভেদের মধ্যে নিহিত। বিভিন্ন জেনেটিক, পরিবেশগত এবং জীবনযাত্রার কারণ এর বিকাশে অবদান রাখে। এ রোগ অস্থিসন্ধির প্রদাহ, ফোলা, শক্ত হয়ে যাওয়া এবং ব্যথা সৃষ্টি করে, যা জীবনযাত্রার মানকে হ্রাস করে দেয়। এর বিভিন্ন প্রকারভেদ রয়েছে, যেমন—
অস্টিওআর্থ্রাইটিস: এটি সবচেয়ে সাধারণ রূপ, যা জয়েন্টের তরুণাস্থি বা কার্টিলেজের ক্ষয়ের কারণে ঘটে।
রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস: এটি একটি অটোইমিউন রোগ, যেখানে শরীরের নিজস্ব প্রতিরোধ ক্ষমতা জয়েন্টের লাইনিং-কে আক্রমণ করে।
গাউট: জয়েন্টে ইউরিক অ্যাসিডের ক্রিস্টাল জমার কারণে হঠাৎ তীব্র ব্যথা হয়।
সোরিয়াটিক আর্থ্রাইটিস: সোরিয়াসিস আক্রান্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে দেখা যায়।
অ্যাঙ্কাইলোজিং স্পন্ডিলাইটিস: প্রধানত মেরুদণ্ড ও কোমরের জয়েন্টগুলিকে প্রভাবিত করে।
জুভেনাইল আর্থ্রাইটিস: ১৬ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে দেখা যায়।
লুপাস আর্থ্রাইটিস: সিস্টেমিক লুপাস ইরিথেমেটোসাসের সাথে সম্পর্কিত।
বাত ব্যথার লক্ষণ ও উপসর্গ
বাতে ব্যথার উপসর্গগুলি ধরনভেদে ভিন্ন হলেও সাধারণ লক্ষণগুলির মধ্যে রয়েছে:
(১)আক্রান্ত জয়েন্টে স্থায়ী বা বিরতিহীন ব্যথা।
(২)সকালে বা নিষ্ক্রিয়তার পরে জয়েন্ট শক্ত হয়ে যাওয়া।
(৩)প্রদাহের কারণে জয়েন্ট ফোলা, নরম এবং উষ্ণ অনুভব করা।
(৪)জয়েন্টের চলন ক্ষমতা কমে যাওয়া।
(৫)অনেক ক্ষেত্রে ক্লান্তি বা অবসাদ অনুভব করা, বিশেষত প্রদাহজনিত প্রকারগুলিতে।
বাত ব্যথার কারণ
এ রোগের বিকাশের ক্ষেত্রে বেশ কিছু ঝুঁকি কারণ হিসেবে কাজ করে। যেমন:
(১) জেনেটিক্স: পারিবারিক ইতিহাস থাকলে ঝুঁকি বাড়ে।
(২) বয়স: সাধারণত বয়স্কদের মধ্যে বেশি দেখা যায়।
(৩) লিঙ্গ: রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসের মতো কিছু প্রকার মহিলাদের মধ্যে বেশি সাধারণ।
(৪) আঘাত: পূর্বে জয়েন্টে আঘাত পেলে।
(৫) স্থূলতা: অতিরিক্ত ওজন বহনকারী জয়েন্টগুলিতে চাপ সৃষ্টি করে।
(৬) অটোইমিউন কন্ডিশন: শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার অস্বাভাবিক কার্যকলাপ।
বাত ব্যথার চিকিৎসা
সঠিক রোগ নির্ণয়ের জন্য রোগীর চিকিৎসার ইতিহাস, শারীরিক পরীক্ষা, এক্স-রে/এমআরআই-এর মতো ইমেজিং স্টাডিজ এবং রক্ত পরীক্ষা করা হয়। কিছু ক্ষেত্রে গাউট বা সংক্রমণ নির্ণয়ের জন্য জয়েন্ট অ্যাসপিরেশনের প্রয়োজন হতে পারে।
আরও কিছু উপায়ে এ রোগের নিরাময় করা সম্ভব। যেমন-
জীবনযাত্রার পরিবর্তন: স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখা, নিয়মিত ব্যায়াম এবং বিশ্রাম ও কার্যকলাপের ভারসাম্য।
ফিজিওথেরাপি ও অকুপেশনাল থেরাপি: জয়েন্টের নমনীয়তা এবং দৈনন্দিন কাজ করার ক্ষমতা উন্নত করা।
তাপ ও শীতল থেরাপি: ব্যথা ও প্রদাহ কমাতে ব্যবহার।
সহায়ক সরঞ্জাম: ব্রেস বা ছড়ির মতো সরঞ্জাম ব্যবহার করে জয়েন্টের চাপ কমানো।
সার্জারি: গুরুতর ক্ষেত্রে জয়েন্ট প্রতিস্থাপন বা মেরামতের মতো অস্ত্রোপচার।
জটিলতা
আর্থ্রাইটিসের সঙ্গে সুস্থ জীবন যাপনের জন্য নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, জয়েন্ট সুরক্ষার কৌশল এবং ক্রমাগত পুনর্বাসন অপরিহার্য। সময়মতো সঠিক চিকিৎসা না করা হলে স্থায়ী জয়েন্ট ক্ষতি, বিকৃতি, চলন ক্ষমতার হ্রাস এবং পেশী দুর্বলতা দেখা দিতে পারে। কিছু প্রদাহজনিত আর্থ্রাইটিস হৃদরোগের মতো অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যার ঝুঁকিও বাড়াতে পারে।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এ নীরব ঘাতক থেকে বাঁচতে সচেতনতা বৃদ্ধি, সঠিক খাদ্যাভ্যাস ও সক্রিয় জীবনযাত্রার ওপর জোর দিচ্ছেন।
বাত ব্যথায় কি বাচ্চারা আক্রান্ত হয়?
শিশুদের ক্ষেত্রে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগ পর্যন্ত এ রোগকে জুভেনাইল ইডিওপ্যাথিক আর্থ্রাইটিস নামে অভিহিত করা হয়। পরে এটি প্রাপ্তবয়স্ক বাতরোগের নির্দিষ্ট শাখায় নামকরণ করা হয়।
এর সুনির্দিষ্ট কারণ অজানা, তবে এটি বংশগত প্রবণতা এবং ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের কারণে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার ত্রুটির ফলে হতে পারে। সঠিক সময়ে চিকিৎসা না হলে অস্থিসন্ধির কার্যক্ষমতা নষ্ট হওয়া, শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও মানসিক বিকাশ ব্যাহত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। চিকিৎসায় স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ কম ডোজে ব্যবহার করা হয়, কারণ এটি শিশুর বৃদ্ধি ব্যাহত করতে পারে। ব্যথানাশক ও বাত নিয়ন্ত্রণকারী ওষুধ শিশুর ওজনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দেয়া হয়। রোগ নিয়ন্ত্রণযোগ্য হলেও এটি দীর্ঘমেয়াদী, তাই নিয়মিত ফলোআপে থাকা এবং রোগ ফিরে আসার বিষয়ে সচেতন থাকা জরুরি।
বাতজ্বর ও বাত ব্যথার পার্থক্য কী কী?
বাত জ্বর এবং বাতের ব্যথাকে সাধারণত অনেকেই একই রোগ মনে করেন, কিন্তু আসলে রোগ দুটি ভিন্ন। অনেকে এই দুটিকে গুলিয়ে ফেলেন, কারণ বাত জ্বর এবং বাতের ব্যথা উভয় ক্ষেত্রেই গাঁটে ব্যথা হয়। তবে প্রধান পার্থক্য হলো বাত জ্বরে বড় জয়েন্ট বা গাঁটগুলো আক্রান্ত হয় এবং ফুলে যায়। এ ব্যথা এক গাঁট থেকে অন্য গাঁটে সরে যায়। অন্যদিকে, যাকে সাধারণভাবে বাত বলা হয়, তার অনেক কারণ থাকতে পারে এবং এটি সবসময় বড় জয়েন্টকে ক্ষতিগ্রস্ত করে না, বরং ছোট ছোট জয়েন্টেও হতে পারে। মেকানিক্যাল আর্থ্রাইটিস বা অঙ্গবিন্যাসের সমস্যার কারণেও বাত হতে পারে। এছাড়া, ইউরিক অ্যাসিড বৃদ্ধির ফলে জয়েন্টে ক্রিস্টাল জমে যে গাউট হয়, সেটিও অনেকে বাত বলে মনে করেন।
কোন সময়ে বাত ব্যথা বেশি হয়?
গ্রীষ্ম এবং বর্ষাকালে যখন আর্দ্রতা বেশি থাকে, তখন বাত ব্যথা বেড়ে যায়। এছাড়া, দিনের নির্দিষ্ট কিছু সময়ে, যেমন সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর বা দীর্ঘক্ষণ বসে থাকার পর, ব্যথা বেশি হতে পারে।
গ্রীষ্ম এবং বর্ষাকালে বাতাসে আর্দ্রতা বেশি থাকার কারণে বাত ব্যথা এবং সংশ্লিষ্ট সমস্যাগুলো বৃদ্ধি পায়। ঘুম থেকে ওঠার পর বা দীর্ঘক্ষণ একভাবে থাকার পর অস্থিসন্ধিগুলোতে জড়তা ও ব্যথা অনুভূত হতে পারে। আবহাওয়ার পরিবর্তনের সময়ও ব্যথা বাড়তে পারে। বেশি পরিশ্রম বা হাঁটাচলার পর ব্যথা বাড়তে পারে। প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার যেমন কিছু মাংস, ডিম এবং কলিজা খেলে বাতের ব্যথা বাড়তে পারে, বিশেষ করে যদি ইউরিক অ্যাসিডের পরিমাণ বেশি থাকে।





