পূজার খাবার: ভক্তি, ঐতিহ্য ও উৎসবের রসনা

দুর্গা পূজা
দুর্গা পূজা | ছবি: সংগৃহীত
1

বাংলাদেশে শারদীয় দুর্গাপূজা মানেই শুধু ধর্মীয় আচার নয়, বরং এক অনন্য সামাজিক উৎসব। ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির থেকে শুরু করে গ্রামের ছোট ছোট মণ্ডপ পর্যন্ত; যেখানেই পূজার আয়োজন হয়, সেখানেই মিলনমেলায় পরিণত হয় পরিবেশ। পূজার মূল আকর্ষণ যেমন প্রতিমা দর্শন, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও মেলামেলা, তেমনই অন্যতম বড় আকর্ষণ খাবার। কারণ, পূজা মানেই আনন্দ। আর আনন্দের সঙ্গে খাবারের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য।

পূজার ভোগ: ভক্তির প্রতীক

দুর্গাপূজার মূল আচারগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ভোগ নিবেদন। প্রতিদিন দেবীর উদ্দেশে বিভিন্ন ধরনের নিরামিষ খাবার নিবেদন করা হয়। সাধারণত খিচুড়ি, লাবড়া, পায়েস, ভাজি ও ডাল-সবজি দিয়ে সাজানো হয় ভোগের থালা। শাস্ত্রীয় নিয়মে ভোগ নিরামিষ হলেও আধুনিক সময়ে অনেক জায়গায় মাছ কিংবা মিষ্টির বৈচিত্র্যও দেখা যায়। ভোগ শুধু দেবীর জন্য নয়, পূজা শেষে প্রতিটি ভক্ত ভোগ গ্রহণ করে থাকেন, যা ‘প্রসাদ’ নামে পরিচিত। এ প্রসাদ ভক্তির নিদর্শন হিসেবে এক ধরনের ‘আধ্যাত্মিক’ তৃপ্তি এনে দেয়।

পূজার খাবার |ছবি: সংগৃহীত

নিরামিষ রান্নার বৈচিত্র্য

পূজার সময় নিরামিষ রান্নার আলাদা মাহাত্ম্য রয়েছে। গ্রামে কিংবা শহরে, সব জায়গায়ই খিচুড়ির জনপ্রিয়তা সবচেয়ে বেশি। সঙ্গে থাকে লাবড়া, যা নানা সবজি একসঙ্গে মশলাদার করে রান্না করা হয়। বেগুন ভাজা, কুমড়ো ভাজা, আলুর দম, ডাল; এসব খাবারেই তৈরি হয় ভোগের মূল আয়োজন। কোথাও কোথাও নারকেলের চাটনি, টক ডাল বা কচুশাকের ভর্তাও ভোগের অংশ হয়ে ওঠে। পূজার দিনে এই নিরামিষ ভোজ শুধু শরীর নয়, মনকেও পরিশুদ্ধ করে বলে বিশ্বাস করা হয়।

নিরামিষ খাবারের থালা |ছবি: সংগৃহীত

মিষ্টির আয়োজন

পূজা মানেই মিষ্টির বাহার। চিতই পিঠা থেকে শুরু করে ক্ষীরের সন্দেশ, লাড্ডু, রসগোল্লা, চমচম কিংবা চিতই পিঠার মতো দেশি আইটেম; সবই দেখা যায় পূজার দিনে। শহরের বড় বড় পূজা মণ্ডপগুলোতে মিষ্টির দোকানগুলোতে থাকে বিশেষ আয়োজন। অনেকে আবার বাড়িতে নিজেরাই ক্ষীর দিয়ে পায়েস, নারকেলের নাড়ু বা মোয়া বানান। শিশু থেকে বৃদ্ধ, সবার মুখে হাসি ফোটে এসব মিষ্টির স্বাদে।

পূজার মিষ্টি |ছবি: সংগৃহীত

মাছ ও মাংসের বিশেষ দিন

যদিও পূজার ভোগে নিরামিষের গুরুত্ব বেশি, তবে পূজা উপলক্ষে পারিবারিক আয়োজনে মাছ-মাংসও থাকে বিশেষভাবে। সপ্তমী, অষ্টমী বা নবমীর দিনে অনেক পরিবারে ইলিশ মাছের ঝোল, চিংড়ি মালাইকারি বা মুরগির কোরমা রান্না করা হয়। অতিথি আপ্যায়নে এসব পদ দারুণ জনপ্রিয়। গ্রামে তো আবার পূজার মেলা মানেই গরুর মাংসের ঝোল আর গরম ভাতের জম্পেশ আয়োজন।

আমিষ খাবারের থালা |ছবি: সংগৃহীতআ

মেলার খাবারের রঙিন দুনিয়া

পূজার আরেকটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো মেলা। পূজামণ্ডপের পাশে বসা মেলায় পাওয়া যায় জিলাপি, গজা, খাজা, বেলুনের মতো রঙিন খাবার, ফুচকা, চটপটি আর ঘুগনির দোকান। ছোটরা মেলায় ঘুরতে এসে মিষ্টি হাতে পায়, আর বড়রা ফুচকা-চটপটির লাইনে দাঁড়িয়ে যান। এ খাবারগুলো মেলাকে শুধু আনন্দমুখরই করে না, বরং স্থানীয় অর্থনীতিরও এক বড় অংশ জুড়ে থাকে।

মেলা |ছবি: সংগৃহীত

আধুনিক ছোঁয়া

সময় বদলেছে, বদলেছে পূজার খাবারের ধরনও। এখন অনেক মণ্ডপে দেখা যায় বিরিয়ানির আয়োজন, এমনকি ফাস্টফুডও। তরুণ প্রজন্মের জন্য পিৎজা, বার্গার কিংবা নুডলসও জায়গা করে নিয়েছে পূজার মেলায়। তবে ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিকতার এ মেলবন্ধনই আজকের পূজাকে আরও প্রাণবন্ত করে তুলেছে।

খাবারের সামাজিক তাৎপর্য

পূজার খাবার শুধু পেট ভরানোর উপায় নয়, বরং এটি সামাজিক সম্প্রীতিরও প্রতীক। মুসলিম, হিন্দু বা অন্যান্য সম্প্রদায়; সবাই মিলে পূজার ভোগ গ্রহণ করেন, মেলায় অংশ নেন। খিচুড়ির পাত একসঙ্গে ভাগাভাগি করা মানেই ভ্রাতৃত্বের বন্ধনকে দৃঢ় করা। এ কারণে পূজার খাবার সামাজিক সম্প্রীতি ও মিলনমেলার প্রতীক হয়ে উঠেছে।

পূজার ভোগ |ছবি: সংগৃহীত

শারদীয় দুর্গাপূজা শুধু দেবী দুর্গার বন্দনা নয়, বরং এটি বাংলার মানুষের প্রাণের উৎসব। প্রতিমার জ্যোতি, ঢাক-ঢোলের আওয়াজের সঙ্গে খাবারের আয়োজন এ উৎসবকে পূর্ণতা দেয়। নিরামিষ ভোগ, মিষ্টির বাহার, মাছ-মাংসের আয়োজন কিংবা মেলার ফুচকা; সবকিছু মিলে পূজার খাবার হয়ে ওঠে ভক্তি, ঐতিহ্য ও উৎসবের রঙিন ছোঁয়া।

এনএইচ