ক্যানোলা তেল সম্পর্কে যে তথ্যগুলো জানা দরকার

ক্যানোলা তেল
ক্যানোলা তেল | ছবি: সংগৃহীত
1

ক্যানোলা তেল একটি সহজলভ্য এবং স্বাস্থ্যকর রান্নার তেল। এতে কোনো ট্রান্স ফ্যাট নেই এবং অন্য যেকোনো সাধারণ রান্নার তেলের চেয়ে সম্পৃক্ত ফ্যাট সবচেয়ে কম। এটি বহুমুখী এবং সাশ্রয়ী হওয়ায় গৃহস্থালি ও বাণিজ্যিক উভয় ক্ষেত্রেই স্বাস্থ্যকর খাবারের জন্য আদর্শ।

ক্যানোলা তেল কীভাবে তৈরি হয়?

ক্যানোলা তেল আসে ক্যানোলা গাছের বীজ থেকে। এ গাছ দেখতে সরিষার মতো, যেখানে ছোট ছোট হলুদ ফুল ফোটে। এ ফুল থেকে মটরের শুঁটির মতো দেখতে ফল হয়, যার মধ্যে থাকে ছোট কালো বীজ। প্রতিটি বীজে প্রায় ৪৫ শতাংশ তেল থাকে। ফসল তোলার পর এ বীজগুলো ভেঙে তেল বের করে পরিশোধন করা হয়।

অনেকে ক্যানোলা এবং রেপসিডকে একই মনে করেন, কারণ ক্যানোলা গাছ রেপসিড থেকেই তৈরি হয়েছে এবং দেখতেও একরকম। তবে, ক্যানোলাতে রেপসিডের চেয়ে ইরুসিক অ্যাসিড এবং গ্লুকোসিনোলেটসের পরিমাণ অনেক কম থাকে। ক্যানোলাকে 'ক্যানোলা' হিসেবে স্বীকৃতি পেতে হলে তেলে ২ শতাংশের কম ইরুসিক অ্যাসিড এবং ৩০ মাইক্রোমোল/গ্রামের কম গ্লুকোসিনোলেটস থাকতে হবে।

কানাডার ক্যানোলা কাউন্সিল অনুসারে, ক্যানোলা বীজ থেকে তেল তৈরির প্রক্রিয়া অন্যান্য তেলবীজের মতোই। এ প্রক্রিয়াটি কয়েকটি প্রধান ধাপে বিভক্ত। যেমন-

বীজ পরিষ্কার করা

তেল তৈরির প্রথম ধাপে, ক্যানোলা বীজগুলোকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরিষ্কার করা হয়। এর কারণ হলো ফসল তোলার সময় বীজের সাথে থাকা কাণ্ড, শুঁটি, আগাছার বীজ এবং অন্যান্য অবাঞ্ছিত উপাদান দূর করা। এই প্রাথমিক পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করে যে চূড়ান্ত পণ্যটি সর্বোচ্চ মানের হবে।

গরম ও ফ্লেকিং করা

পরিষ্কার করার পর, ক্যানোলা বীজগুলোকে মেশিনের সাহায্যে গরম করা হয় এবং ফ্লেক বা পাতলা টুকরায় পরিণত করা হয়। এই পর্যায়ে, বীজের তাপমাত্রা সামান্য বাড়ানো হয় যাতে সেগুলো ভেঙে না যায়। এরপর বীজগুলোকে রোলার মেশিনের মধ্য দিয়ে পাঠানো হয়, যা বীজের কোষ প্রাচীর ভেঙে দেয় এবং সেগুলোকে ফ্লেকে রূপান্তরিত করে।

রান্না করা

ফ্লেক করা বীজগুলোকে এরপর এক সারি স্তূপীকৃত কুকার বা উত্তপ্ত ড্রামের মধ্য দিয়ে পাঠানো হয়। এই ধাপে, কোষগুলো আরও ভেঙে যায় এবং সঠিক সান্দ্রতা এবং আর্দ্রতার মাত্রা অর্জন করে, যা পরবর্তী ধাপগুলোর জন্য প্রয়োজন। এই প্রক্রিয়া পণ্যের গুণগত মান ঠিক রাখতে সাহায্য করে।

চাপ প্রয়োগ

উত্তপ্ত ফ্লেকগুলোকে তারপর এক্সপেলার বা প্রেশার মেশিনের মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে চাপ দেওয়া হয়। এ প্রক্রিয়ায় বেশিরভাগ তেল বের হয়ে আসে এবং অবশিষ্ট বীজ একটি কঠিন পিণ্ড বা কেক-এ পরিণত হয়।

নিষ্কাশন

প্রেস করা কেক থেকে অবশিষ্ট তেল হেক্সেন নামক একটি দ্রাবক ব্যবহার করে নিষ্কাশন করা হয়। এই মেশিন তেল এবং কঠিন পদার্থকে আলাদা করে এবং পরবর্তী ব্যবহারের জন্য হেক্সেনকে পুনর্ব্যবহার করে।

ক্যানোলা তেলের পরিশোধন ও প্রক্রিয়াজাতকরণ

কাঁচা তেলকে আরও পরিশোধন করা হয় যাতে এর স্বাদ, রঙ এবং সংরক্ষণের মেয়াদ উন্নত হয়। পানি এবং জৈব অ্যাসিড ব্যবহার করে তেল থেকে আঠা, ফ্যাটি অ্যাসিড, সূক্ষ্ম কণার অবশিষ্টাংশ এবং লিপিড দূর করা হয়। এরপর ব্লিচিং নামক একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তেলের রঙ দূর করা হয়, যদিও এতে কোনো ব্লিচ ব্যবহার করা হয় না। এ প্রক্রিয়ায় তেলকে কাদামাটির ছাঁকনির মধ্য দিয়ে প্রবাহিত করা হয় এবং অপ্রীতিকর গন্ধ দূর করতে বাষ্পীয় পাতন করা হয়।

ক্যানোলা তেল তৈরির উপাদান |ছবি: সংগৃহীত

ক্যানোলা তেলের স্বাস্থ্যগুণ এবং উপকারিতা

গবেষণায় দেখা গেছে, ক্যানোলা তেল কিছু দীর্ঘস্থায়ী স্বাস্থ্য সমস্যার ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। এটি মানুষের খাবারের জন্য নিরাপদ এবং শিশুদের ফর্মুলাতেও ব্যবহার করা হয়। আমেরিকান ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ক্যানোলা তেলকে হৃদরোগের ঝুঁকি কমানোর জন্য স্বাস্থ্যকর বলে স্বীকৃতি দিয়েছে, যদি এটি সম্পৃক্ত ফ্যাটের পরিবর্তে ব্যবহার করা হয়। রান্নার তেলের বাজারে ক্যানোলা তেল এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা এর বিভিন্ন উপকারিতার কারণে একে স্বাস্থ্যকর ভোজ্য তেল হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছেন। চলুন জেনে নেই ক্যানোলা তেলের কিছু বিশেষ স্বাস্থ্য উপকারিতা।

ক্যানোলা তেলের প্রধান উপকারিতা:

এতে মাত্র ৭% সম্পৃক্ত ফ্যাট থাকে, যা অন্যান্য সাধারণ তেলের চেয়ে কম। এটি মনোস্যাচুরেটেড ওমেগা-৯ ফ্যাট এবং ওমেগা-৩ ও ওমেগা-৬ ফ্যাটেরও ভালো উৎস। এ ধরনের ফ্যাট রক্তের খারাপ কোলেস্টেরল কমিয়ে হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে।

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে ক্যানোলা তেল হৃদরোগ, ডায়াবেটিস এবং মেটাবলিক সিন্ড্রোম-এর মতো সমস্যাগুলোতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, ক্যানোলা তেল ব্যবহার করলে খারাপ কোলেস্টেরল কমে, টাইপ-২ ডায়াবেটিস রোগীদের কোলেস্টেরল ও গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণ উন্নত হয়, এবং মেটাবলিক সিন্ড্রোমের ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তিদের পেটের মেদ ও রক্তচাপ কমে।

২০১৩ সালের একটি নির্ভরযোগ্য পর্যালোচনায় দাবি করা হয়েছে যে, ক্যানোলা তেল অন্যতম স্বাস্থ্যকর উদ্ভিজ্জ তেল। এটি বিভিন্ন রোগ-সম্পর্কিত কারণ হ্রাস করে এবং সামগ্রিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায়। যদিও এই গবেষণাটি একটি পিয়ার-রিভিউড জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে, এটি ক্যানোলা তেল শিল্পের সাথে জড়িত সংস্থাগুলোর সমর্থনও পেয়েছে।

২০১৬ সালের একটি বই অনুসারে, অনেক পুষ্টিবিদ বিশ্বাস করেন যে ক্যানোলা তেলকে তার ফ্যাটি অ্যাসিডের গঠন এবং অন্যান্য পুষ্টি গুণের কারণে স্বাস্থ্যকর ভোজ্য তেল হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। এতে অন্যান্য উদ্ভিজ্জ তেলের তুলনায় সম্পৃক্ত চর্বির পরিমাণও কম থাকে।

২০১১ সালের আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, যেসব মানুষ সম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ অন্যান্য তেলের চেয়ে বেশি ক্যানোলা তেল ব্যবহার করেন, তাদের শরীরে লিপিড কমানোর প্রভাব দেখা যেতে পারে। গবেষকরা আরও পরামর্শ দিয়েছেন যে ক্যানোলা তেলকে হৃদপিণ্ডের জন্য স্বাস্থ্যকর হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।

ক্যানোলা তেলে বিদ্যমান অসম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিড, যেমন ওমেগা-৩ এবং ওমেগা-৬, হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। এর কম স্যাচুরেটেড ফ্যাট উপাদান কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়ক। এই গুণগুলো ক্যানোলা তেলকে দৈনন্দিন রান্নার জন্য একটি চমৎকার পছন্দ হিসেবে গড়ে তুলেছে।

ক্যানোলা তেলের ব্যবহার এবং পুষ্টিগত তুলনা:

ক্যানোলা তেলের হালকা স্বাদ ও পাতলা গড়নের কারণে এটি যেকোনো ধরনের রান্নার জন্য উপযুক্ত। এটি সবজি ভাজি, বেকিং, এমনকি সালাদ ড্রেসিং-এর জন্যও দারুণ। এর উচ্চ স্মোক পয়েন্ট প্রায় ডিগ্রি সেলসিয়াস একে ভাজা ও সাঁতলানোর জন্য আদর্শ করে তোলে।

রান্নায় ক্যানোলা তেল |ছবি: সংগৃহীত

ক্যানোলা তেলের ক্ষতিকর দিক

ক্যানোলা তেল, যা প্রায়শই হৃদপিণ্ডের জন্য স্বাস্থ্যকর একটি বিকল্প হিসেবে প্রচারিত হয়, তা নিয়ে সাম্প্রতিক কিছু গবেষণা ভিন্ন চিত্র তুলে ধরছে। যদিও বাজারজাতকারিরা এটিকে প্রায়শই অন্যান্য তেলের তুলনায় নিরাপদ বলে দাবি করেন, তবে কিছু গবেষণা এর সম্ভাব্য ঝুঁকির দিকে ইঙ্গিত করছে।

হৃদপিণ্ডের স্বাস্থ্য

একটি ২০১৮ সালের গবেষণায় বলা হয়েছে যে, যারা রান্নার জন্য ক্যানোলা তেল ব্যবহার করেন, তাদের মেটাবলিক সিন্ড্রোম হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকতে পারে। এটি এমন একটি অবস্থা যা হৃদরোগ, স্ট্রোক এবং টাইপ ২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ায়। এ গবেষণাটি সেইসব দাবির বিপরীত, যেখানে বলা হয় ক্যানোলা তেল হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়। উল্লেখ্য, যে গবেষণাটি ক্যানোলা তেলকে উপকারী বলে দাবি করে, সেটির অর্থায়ন ছিল ক্যানোলা শিল্প-সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে।

প্রদাহ

বেশ কিছু প্রাণী-ভিত্তিক গবেষণায় দেখা গেছে যে ক্যানোলা তেল অক্সিডেটিভ স্ট্রেস এবং প্রদাহ বা ইনফ্ল্যামেশন বাড়াতে পারে। একটি ২০২০ সালের গবেষণায় দেখা যায়, বড় হলুদ ক্রকার মাছকে ৬ শতাংশ এর বেশি রেপসিড তেলযুক্ত খাবার দিলে তাদের শরীরে প্রদাহজনিত প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। একই ধরনের একটি ২০১৮ সালের গবেষণায় ইঁদুরের ওপর পরীক্ষা করে দেখা গেছে, ক্যানোলা তেল গরম করলে এমন কিছু যৌগ তৈরি হয় যা প্রদাহজনিত মার্কার বা প্রদাহের নির্দেশক বাড়িয়ে দেয়।

স্মৃতিশক্তির ওপর প্রভাব

২০১৭ সালে আলঝেইমার’স রোগের লক্ষণ সৃষ্টিকারী ইঁদুরের ওপর পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা যায়, নিয়মিত ক্যানোলা তেল গ্রহণ তাদের স্মৃতিশক্তির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এটি ইঙ্গিত দেয় যে দীর্ঘমেয়াদী ব্যবহার স্মৃতিশক্তি হ্রাসের কারণ হতে পারে।

আরও পড়ুন:

এ গবেষণাগুলি ক্যানোলা তেল ব্যবহারের বিষয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে। যদিও এটি সম্পূর্ণরূপে ক্ষতিকর না উপকারী, তা নিয়ে আরও বিস্তারিত গবেষণার প্রয়োজন। তাই, ভোক্তাদের জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা তাদের খাদ্য নির্বাচনের সময় বিবেচনায় রাখা উচিত।

ক্যানোলা বনাম সয়াবিন তেল

পুষ্টি:

ক্যানোলা তেলে কম সম্পৃক্ত ফ্যাট এবং বেশি মনোস্যাচুরেটেড ফ্যাট থাকে, সঙ্গে ওমেগা-৩ ও ওমেগা-৬ ফ্যাট এবং ভিটামিন-ই। অন্যদিকে, সয়াবিন তেলে কম সম্পৃক্ত ফ্যাট এবং বেশি পলি-আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট থাকে, যা ওমেগা-৬ এর ভালো উৎস, তবে এতে ওমেগা-৩ কম। সয়াবিন তেল ভিটামিন-কে সমৃদ্ধ।

স্বাদ ও ব্যবহার:

ক্যানোলা তেলের হালকা স্বাদ অন্যান্য উপকরণের স্বাদকে ধরে রাখে। এর স্মোক পয়েন্ট ২০৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সয়াবিন তেলের স্বাদ সামান্য শক্তিশালী এবং এর স্মোক পয়েন্ট বেশি প্রায় ২৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। উভয়ই ভাজা ও সালাদ ড্রেসিংয়ের জন্য ব্যবহৃত হয়, তবে সয়াবিন তেল বাণিজ্যিক খাদ্য উৎপাদনে বেশি প্রচলিত।

সংরক্ষণ:

উভয় তেলেরই সংরক্ষণ ক্ষমতা ভালো, তবে সয়াবিন তেলে পলি-আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট বেশি থাকায় ক্যানোলা তেলের চেয়ে এর স্থায়িত্ব কম হতে পারে। উভয়ই ৬ থেকে ১২ মাসের মধ্যে ব্যবহার করা উচিত এবং ঠাণ্ডা, অন্ধকার জায়গায় সংরক্ষণ করা ভালো।

ইএ