একটি একা পাখি, সঙ্গহীন বা নিঃসঙ্গ। এখন আর ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি ওড়ে বেড়ায় না শহর, গ্রাম বা মফস্বলে ভোরে মুয়াজ্জিনের আজানের সাথে সাথে নরসিংদীর প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে কিছু পাখির ঝাঁক তাদের অস্তিত্ব জানান দিলেও ধোঁয়াটে শহরের উঘ্নতায়, শহুরে দেয়ালের কার্নিশে খুব একটা দেখা মেলে না কাঠঠোকরা, বুলবুলি, দোয়েল, শ্যামা ও ফিঙে সহ অন্যান্য দেশীয় পাখির। চড়ুই, ইষ্টিকুটুম বা ডাহুকের বাসা খুঁজতে বনে বাঁদাড়ে ঘুরে বেড়ানো শৈশব এখন ঘোলাটে স্মৃতির প্রচ্ছদ।
প্রকৃতি সংরক্ষণ বিষয়ক আন্তর্জাতিক ইউনিয়ন সর্বশেষ পাখি নিয়ে জরিপ করে ২০১৫ সালে। সে সময়ের জরিপে বাংলাদেশে ৬৫০ প্রজাতি পাখির অস্তিত্ব খুঁজে পায় সংস্থাটি। তবে বর্তমানে দেশে পাখি রয়েছে ৪৭৭ প্রজাতির।
গবেষকদের দেয়া তথ্য বলছে, বর্তমানে বিশ্বে ১১ হাজার প্রজাতির পাখি রয়েছে। আর বাংলাদেশে আছে ৪৭৭ প্রজাতির পাখি। এর মধ্যে ৩০১ প্রজাতির পাখি বাংলাদেশের ‘আবাসিক’ পাখি। বাকি ১৭৬ প্রজাতি ‘পরিযায়ী’ বা অতিথি পাখি। গত ৯ বছরে দেশে প্রায় ১৭৩ প্রজাতির পাখি বিলুপ্তির দিকে এগিয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে কেন কমছে এসব পাখি?
নরসিংদী সরকারি কলেজ প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রভাষক মাইন উদ্দিন বলেন, ‘পাখিদের খাদ্য শৃঙ্খলার বিরাট একটা ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এখন গ্রাম অঞ্চলেও গাছ-পালা কমে গিয়েছে। মানুষ প্রাকৃতিক গাছ কেটে কাঠের গাছ বেশি লাগাচ্ছে। যা পাখির বাসার জন্য শ্রেয় না। এই গাছগুলো মানুষের জন্য আর্থিক লাভবান হলেও পাখিদের খাদ্য শৃঙ্খলা ও বাসস্থানের ঘাটতি হচ্ছে। ’
নরসিংদীর পরিবেশ ও জলবায়ু কর্মী বালাক রাসেল বলেন, ‘কারখানা ও ফ্যাক্টরিগুলো যে পরিমাণে ধোঁয়া নির্গত হচ্ছে। এগুলো যখন গাছের মধ্যে যায় তখন গাছের ডাল ও পাতা আঠালো হয়ে পড়ে। যার ফলে পোকামাকড় থাকে না। এতে পাখি খাবার পায় না। যা পাখির বিলুপ্তি ভূমিকা রাখছে বলে আমি মনে করি।’
প্রকৃতি সংরক্ষণ বিষয়ক আন্তর্জাতিক ইউনিয়নের তথ্যমতে, গত ১০০ বছরের মধ্যে ১৯ প্রজাতির পাখি চিরতরে হারিয়ে গেছে। গবেষক ও পাখি বিশেষজ্ঞদের মতে, সারা বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পাখি কমছে এশিয়া মহাদেশে। আর এর মধ্যেই এই হার সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশে। গত ৩০ বছরে দেশে পাখির সংখ্যা নেমেছে ৬ ভাগের এক ভাগে।
পাখি কমার কারণ হিসেবে একাধিকবার উঠে এসেছে পর্যাপ্ত বাসস্থান না থাকা, পতিত জমি, জলাধার ও বনাঞ্চল কমে যাওয়া, কৃষিকাজে বিষ ও রাসায়নিক ব্যবহার। বর্তমানে দেশের মোট আয়তনের সাড়ে ১৫ শতাংশ এলাকায় বনভূমি রয়েছে, যদিও প্রয়োজন ২৫ শতাংশ। ২০০১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা কমেছে প্রায় চার লাখ ৯৪ হাজার ২১১ একর। সামাজিক বনায়নে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা চলছে জানিয়ে বনভূমি কমার কারণ তুলে ধরলেন বন কর্মকর্তা। সমাধানের কারণ তুলে ধরলেন সংশ্লিষ্টরা।
নরসিংদী ভারপ্রাপ্ত বন কর্মকর্তা মো. হায়দার হোসেন বলেন, ‘ বর্তমানে নরসিংদীতে পাখি নিয়ে কোনো কাজ হচ্ছে না, আমরা এমন কোনো দিক নির্দেশনা ও বরাদ্দ পাইনি। তবে কেউ যদি পাখি অবৈধভাবে ধরার চেষ্টা করে তাহলে আমরা তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিচ্ছি।’
নরসিংদীর জেলা প্রাণীসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো ছাইফুল ইসলাম বলেন, ‘ কোনো এলাকায় শিল্পায়ন বেশি হবে আবার কোনো এলাকায় নগরায়ণ বেশি হবে। এর ফলে গাছে কমে যাবে। আর গাছ কমে গেলেই পাখির সংখ্যা কমে যায়।’
নরসিংদী জেলায় কোনো প্রাকৃতিক বনভূমি না থাকায় এখানকার বনভূমির পরিমাণ জানাতে পারেনি বন বিভাগ। তবে, পুরো দেশে বর্তমানে মোট বনভূমির পরিমাণ ২৫ লক্ষ ৭৫ হাজার হেক্টর।