রাজধানীর একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের অষ্টম শ্রেণির নতুন মুখ মৌমিতা জাহান মালিহা, ডেনিয়েল চাকমা, তাইফ জোনায়েদ, আর্নেট মেজি খীসা। সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত তারা বাংলা মাধ্যমে পড়াশোনা করেছে। কেবল এরা চারজন নয়, এই স্কুলে শিক্ষাবর্ষের মাঝামাঝিতে নতুন ভর্তি হয়েছে অন্তত ২০ জন। কিন্তু হঠাৎ করে কেন মাধ্যমিকে এসেই ঝুঁকতে হলো ইংলিশ মিডিয়ামে?
মৌমিতা জাহান মালিহা বলেন, 'নতুন কারিকুলাম আব্বু- আম্মুর পছন্দ হয়নি। আমারও হয়নি।'
ডেনিয়েল চাকমা বলেন, 'স্কুলে পরিবর্তন করার কারণ হলো কারিকুলাম চেঞ্জের জন্য।'
২০২৩ সালে নতুন শিক্ষাক্রম চালুর পর থেকে অভিভাবকদের মাঝে দেখা যায়, নানান প্রতিক্রিয়া। তাদের অনেকের ধারণা সন্তানরা পড়াশোনা করছে না, শিখনে থাকছে ঘাটতি। আর সবচেয়ে বড় আপত্তির জায়গা 'মূল্যায়ন পদ্ধতি' নিয়ে।
বাংলা মিডিয়াম থেকে সন্তানকে ইংলিশ মিডিয়ামে নিয়ে আসা একজন অভিভাবক বলেন, 'আমার মনে হয়েছে কারিকুলামে সমস্যা আছে। আমরা কাছে ভালো লাগেনি। এই কারণে আমি ইংলিশ মিডিয়ামে নিয়ে আসছি।'
নতুন শিক্ষাক্রমের মূল্যায়নের পদ্ধতি নিয়ে আপত্তি অনেক অভিভাবকেরই। সেজন্য আস্থা হারিয়ে সামর্থ্যবানদের অনেকেই ঝুঁকছেন ইংলিশ মিডিয়ামে।
দেশে প্রায় দেড়শোটির মতো ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল রয়েছে। যার বেশির ভাগই ব্রিটিশ কারিকুলাম অনুযায়ী পরিচালিত হয়। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল 'একাডেমিয়া'র পরিচালক বলছেন, ইংলিশ মিডিয়ামে তারা শিক্ষার্থীকে বছরজুড়েই ধারাবাহিক মূল্যায়ন করে থাকেন। সঙ্গে থাকে লিখিত পরীক্ষাও।
একাডেমিয়ার পরিচালক কুতুব উদ্দিন। ছবি : এখন টিভি
একাডেমিয়ার পরিচালক কুতুব উদ্দিন বলেন, 'একটা হাফ ইয়ারলি এবং আরেকটি ফাইনাল হয়। এই হাফ ইয়ারলি ও ফাইনালের মাঝখানে একটা করে মিডটার্ম থাকে। এগুলোর ওপর ডিপেন্ড করে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা হয়ে থাকে। এর মধ্যে আপটু গ্রেড টু পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের দৈনন্দিন বিভিন্ন কাজের ওপর ভিত্তি করে মূল্যায়ন করা হয়ে থাকে। সেখানে তাদের দেখা হয় ভাষাতে কতটুকু পারদর্শী, তার ম্যাথের অ্যানালাইটিক্যাল পাওয়ার কতটুকু আছে, তার সাইন্সের নলেজ কেমন আছে। এই তিনটা বিষয়ের ওপরে খুব বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। তারা পাশাপাশি আমাদের মাতৃভাষা বাংলাও গুরুত্ব পেয়ে থাকে সমানভাবে।'
নতুন শিক্ষাক্রম পরিবর্তনের আগে প্রস্তুতির ঘাটতি হয়েছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক সৈয়দা আতিকুন নাহার । মূল্যায়ন পদ্ধতি ও সক্ষমতার বিষয়টি দ্রুত সমাধানের তাগিদ দিচ্ছেন তিনি।
সহযোগী অধ্যাপক সৈয়দা আতিকুন নাহার। ছবি: এখন টিভি
তিনি বলেন, 'শিক্ষক সংখ্যা বাড়ানো, যোগ্য শিক্ষক নিয়ে আসা এবং শিক্ষকের ট্রেনিং বাড়ানো। একই সঙ্গে অভিভাবকের কাছে কারিকুলাম সম্পর্কে পরিষ্কার করা।'
দেশের ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোয় ব্রিটিশ কারিকুলাম অনুসরণ করা হলেও যুক্তরাজ্যে যেভাবে পড়ানো হয়, ঠিক সেভাবে পড়ানো হয় না এখানে। বরং জাতীয় শিক্ষাক্রমের সঙ্গে কিছুটা সামঞ্জস্য রেখেই শিক্ষা কার্যক্রম চালাতে হয় তাদের। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড বলছে, নতুন শিক্ষাক্রমের সাথেও মিল রাখতে বাধ্য থাকবে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলো।
এনসিটিবির সদস্য অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান বলেন, 'আমরা এটা নিশ্চিতভাবে জানি, এখানে ব্রিটিশ কারিকুলামের যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো চলছে তারা খুব শিগগিরিই চেষ্টা করবে আমাদের জাতীয় শিক্ষাক্রমের সঙ্গেও মিল রাখতে। এটাই স্বাভাবিক।কারণ তাকে এখানে যদি চলতে হয় তাহলে জাতীয় শিক্ষাক্রমের সঙ্গে মিল রাখতে বাধ্য থাকবে।'
অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান । ছবি: এখন টিভি
বর্তমানে বাংলাদেশের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় প্রতি ৩৫-৪০ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে শিক্ষক মাত্র এক জন। আর বিদেশি কারিকুলামে পরিচালিত এসব ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে দেখা যায়, সর্বোচ্চ ১০ জন শিক্ষার্থীর বিপরীতে ১ জন করে শিক্ষক। শিক্ষাবিদরা মনে করেন, নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে শিক্ষক শিক্ষার্থীর অনুপাত যেমন কমিয়ে আনতে হবে, তেমনি সব মহলে নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে বাড়াতে হবে সচেতনতাও।