২০১০ এর পর থেকে যার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০ থেকে ২০ হাজার কোটি টাকা। তাই বাজারের এই গলার কাঁটাকে দূর করতে নতুন মার্জিন ঋণ আইন প্রস্তাব করেছে টাস্কফোর্স। আইন বাস্তবায়নের আগে মার্জিন ঋণের বর্তমান সমস্যা সমাধানের প্রয়োজন বলে জানান ব্রোকারেজ মালিকরা। আর নতুন আইন বাস্তবায়নে পুঁজিবাজার ও বিনিয়োগকারীদের ক্ষতি কমবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের ৫০ থেকে ৮০ শতাংশ মার্জিন লোন বা বিনিয়োগ ঋণ সুবিধা পেয়ে থাকেন বিনিয়োগকারী। ক্রয় করা শেয়ার ও ইউনিটের বিপরীতে নির্ধারিত সুদে এ ঋণ দিয়ে থাকে মার্চেন্ট ব্যাংক এবং ব্রোকারেজ হাউস।
তবে ঋণ দেয়ার সীমা মানে না অনেক প্রতিষ্ঠান। কোনো কোনো সময় গ্রাহকের বিনিয়োগের বিপরীতে দশগুণ পর্যন্ত ঋণ দেয় বিভিন্ন ব্রোকারেজ। এর ফলে বাজারে ভয়াবহ নেতিবাচক অবস্থা তৈরি হয়। ২০১০ সালেও মার্জিন ঋণের কারণে শেয়ারবাজারে বড় বিপর্যয় হয়েছে।
মার্জিন ঋণের ভয়াবহতা নিয়ে ২০১৭ সালের মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভের প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, বাজার উত্থান-পতনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হলো মার্জিন ঋণ। আর জার্মানির এক প্রতিবেদনে এই ঋণকে বাজারের জন্য অভিশাপ বলা হয়েছে।
আর্থিকভাবে শক্তিশালী বিনিয়োগকারীরা মার্চেন্ট ব্যাংকের সঙ্গে আঁতাত করে বেশি পরিমাণে ঋণ নেয় কারসাজ চক্র। ফলে তারা ইচ্ছেমতো দুর্বল মৌলভিত্তির শেয়ার নিয়ে কারসাজির মাধ্যমে সেগুলোর দাম অতিমূল্যায়িত করে । এরপর বাজারে মূল্য সংশোধন হলে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
২০১১ সালে দেশের শেয়ারবাজারে মার্জিন ঋণ নিয়ে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন-এমন বিনিয়োগকারীর সংখ্যা ছিল ৬ লাখ ৬৯ হাজার। আর তাদের মোট ক্ষতির পরিমাণ ১০ হাজার ৭০ কোটি টাকা। আর সবশেষ এর পরিমাণ ১৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি হওয়ায় আশঙ্কা করা হয়েছে।
এছাড়া পতিত আওয়ামী সরকারের আমলে মার্জিন ঋণ নিয়ে কারসাজির সুযোগ করে দিয়েছে খায়রুল ও শিবলী কমিশনার। যার মাধ্যমে বাজার থেকে হাতিয়ে নেয়া হয়েছে এক লাখ কোটি টাকার বেশি। আর পতন হলে ফ্লোর প্রাইসের মাধ্যমে এ ঋণের সুদের চাপে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন প্রতিষ্ঠান ও ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী।
তাই ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর পুঁজিবাজার সংস্কারে ইতোমধ্যে মার্জিন ঋণের খসড়া আইন প্রস্তাব টাস্কফোর্স জমা দিয়েছে।
২০১০ এর পর থেকে দেশের পুঁজিবাজারে মার্জিন লোনের দায় কাগজে কলমে রয়েছে ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। তবে এ দায় ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি হবে বলে দাবি জানান অনেক প্রতিষ্ঠান। সেক্ষেত্রে অপরিকল্পিত ঋণ প্রদানে কারসাজিকারীদের ফায়দা হলেও বড় ক্ষতি হয়েছে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের। তাই বিনিয়োগ সুরক্ষার অংশ হিসেবে মার্জিন ঋণ ব্যবস্থায় বড় পরিবর্তন আনা হয়েছে।
প্রস্তাবে ঋণ সুবিধা পেতে হলে বিনিয়োগ থাকতে হবে সর্বনিম্ন ১০ লাখ টাকা। সেই সাথে কমপক্ষে ৬ মাসের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। তবে ঋণ নিয়ে উদ্যোক্তা শেয়ার কিনতে পারবে না । এছাড়া ব্যক্তির ধারাবাহিক প্রতিনিয়ত আয় না থাকলে পাওয়া যাবে না এ ঋণ।
এদিকে আইন বাস্তবায়নের আগে মার্জিন ঋণের বর্তমান সমস্যা সমাধানের প্রয়োজন বলে জানান ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি।
ডিএসই ব্রোকার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘অলরেডি আমাদের এখানে পাহাড় সমান সমস্যা আছে। আমরা এটাকে ক্যান্সারিয়াস ডিজিস ফর দ্য মার্কেট বলে থাকি। কেউ বলে ১০ হাজার কোটি কেউ বলে ২০ হাজার কোটি, কাছাকাছি টাকা এরইমধ্যে ননপারফর্মিং অ্যাসেটস হিসেবে আছে।’
তিনি বলেন, ‘ডিফল্ট অ্যাকাউন্টে মার্জিন লেনদেন ডিফল্ট করার কোনো সুযোগ নেই। আপনি ক্রাইটেরিয়া দিয়ে দিবেন। যেকোনো ব্যাংকে গেলে আপনি এনটাইটেলড কিনা সেটি দেখার সুবিধা থাকে। আপনি দিবেন, কিন্তু যখন আপনি হাত-পা বেধে দেবে তখন মিসইউজ ও অ্যাবিউজ হয়।’
অপরদিকে নতুন আইন বাস্তবায়ন হলে মার্জিন ঋণের মাধ্যমে পুঁজিবাজার ও বিনিয়োগকারীদের ক্ষতিরসুযোগ কম হবে বলে জানান সংস্কারের ফোকাস গ্রুপের সদস্য।
পুঁজিবাজার সংস্কার ফোকাস গ্রুপের সদস্য মো. মনিরুজ্জামান বলেন, ‘২০১০ এর পর থেকে মার্কেটে অনেক লোক মার্জিন লোনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। আমরা এটা একটি লিমিট করতে চেয়েছি। যেন সবাই এসেই মার্জিন লোন না নিতে পারেন। যাদের অভিজ্ঞতা আছে, যাদের ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার সক্ষমতা আছে তারাই যেন শুধু মার্জিন লোন নেয়।’
বর্তমানে বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে লেনদেনযোগ্য বিও অ্যাকাউন্টের সংখ্যা ১৭ লাখ ৫০ হাজার। এসব বিও অ্যাকাউন্টে মোট শেয়ার সংখ্যা ১০ হাজার ১৪১ কোটি। আর এসব শেয়ারের সর্বশেষ বাজারমূল্য ৩ লাখ ৬ হাজার ৮৬৫ কোটি টাকা। এর বিপরীতে বিনিয়োগ ঋণ কম হলেও মন্দা বাজারে সেগুলো এখন গলার কাঁটা।