শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের টার্মিনাল ভবনে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে কীভাবে সাহায্য করতে পারি? ব্যাচধারী কয়েক জনের সতর্ক চলাফেরা। কখনও তারা নিজেই যাচ্ছেন যাত্রীদের কাছে কখনোবা যাত্রীরাও কথা বলছেন তাদের সাথে। জানা যায় যাত্রী সেবার মান বাড়াতেই বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের এমন উদ্যোগ। যারা সহজ করেন বিদেশ যাত্রা।
দেশের প্রধান এই বিমানবন্দরে যাত্রী হয়রানি রোধে চালু করা হয়েছে হটলাইন, সফটওয়্যার, মোবাইল অ্যাপ ও ওয়েবসাইট। লাগেজ পাওয়া যাচ্ছে ১৮ মিনিট থেকে ১ ঘণ্টার মধ্যেই। কমেছে লেফট বিহাইন্ডের সংখ্যাও।
একজন যাত্রী বলেন, 'প্রথম যখন ৬ বছর আগে আসছিলাম তখন ট্রলি হাতে পেতে অনেক সময় লেগেছিল।এখন খুব দ্রুত ট্রলি পেয়ে গেছি। আর হেল্প কেয়ার থেকে যেকোনো তথ্য সহজে পাচ্ছি, কোনো হেজিটেশন হচ্ছে না।'
বর্তমানে এই বিমানবন্দর দিয়ে ওঠানামা করে ৩৪ টি এয়ারলাইন্সের ৩৫০ ফ্লাইট। আর গেলো বছর শাহজালাল বিমানবন্দর ব্যবহার করেছে ১ কোটি ১৫ লাখ যাত্রী। আয় হয়েছে ২হাজার ৪০০ কোটি টাকা।যাত্রী চলাচল ও আয় দুটোতেই রেকর্ড গড়েছে বিমানবন্দরটি।
শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ফ্লাইট ম্যানেজমেন্ট এএমএম স্কোয়াড্রন লিডার মাসুদ বলেন, 'প্রতিদিন এখানে যে ৩৫০টি ফ্লাইট ওঠানামা হচ্ছে সেটা অনেক বড় একটা কর্মযজ্ঞ। এটা আমাদের জন্য অনেক বড় একটা চ্যালেঞ্জ।এর কারণে চেষ্টা করছি যতদ্রুত সম্ভব ফ্লাইটগুলো ওঠানামা করানোর জন্য।'
শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালের কাজ শেষের পথে। ছবি: এখন টিভি
চলছে আইএলএস ক্যাটাগরি-২ এ উন্নীত করার কাজ। বসেছে ফ্রান্সের থ্যালাস কোম্পানির অত্যাধুনিক রাডার। নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন কামরুল ইসলামের লক্ষ্য, প্রবাসী যাত্রীদের সর্বোচ্চ সেবা দেয়া। বললেন, হয়রানি রোধে সংশ্লিষ্ট সবাইকে প্রশিক্ষণের আওতায় আনা হয়েছে।
তিনি বলেন, 'আমাদের যাত্রীদের বড় একটা অংশ হচ্ছে রেমিট্যান্স আর্নাররা। তাদের সর্বোচ্চ সার্ভিস দেয়ার জন্য আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। তাদের যেন তাদের প্রাপ্য সার্ভিসগুলো দিতে পারি।'
শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালে থাকছে ১১৫ টি চেক-ইন কাউন্টার, ১২৮টি ইমিগ্রেশন কাউন্টার, ১২টি বোর্ডিং ব্রিজ,১৬টি লাগেজ বেল্ট, ৩৭ টি উড়োজাহাজ পার্ক করার সক্ষমতা সম্পন্ন অ্যাপ্রোন, ২ টি হাইস্পিড এক্সিট ট্যাক্সিওয়ে, ১২০০ গাড়ি পার্কিং সুবিধা, যাত্রীদের যাতায়াতের জন্য তৃতীয় টার্মিনালের সঙ্গে যুক্ত থাকবে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ও পাতাল মেট্রোরেল।
প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে ৯৭ শতাংশ। সব ঠিক থাকলে চলতি বছরের ডিসেম্বরেই যাত্রীদের জন্য খুলে দেয়া হবে এই টার্মিনাল। তৃতীয় টার্মিনাল ঘিরে ইতোমধ্যেই বাংলাদেশে ফ্লাইট পরিচালনায় আগ্রহ দেখাচ্ছে বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো।
দেশের অ্যাভিয়েশন খাতের আরেক সম্ভাবনার নাম সৈয়দপুর বিমানবন্দর। উত্তর জনপদের যোগাযোগ খাতে গর্ব করার মতন পরিসংখ্যান এনেছে দেশের ব্যস্ততম অভ্যন্তরীণ এই বিমানবন্দর। বর্তমানে এই বিমানবন্দরে চারটি বিমান সংস্থার প্রায় ত্রিশটি ফ্লাইট প্রতিদিন ঢাকা- সৈয়দপুর- ঢাকা রুটে চলাচল করছে।
সৈয়দপুরের সঙ্গে নেপালের ভদ্রপুর ও বিরাট নগরের মধ্যে আকাশ পথের রুট চালুর বিষয়ে বহু আগেই প্রস্তাব দিয়ে রেখেছে নেপাল। নেপাল ও ভুটান ছাড়াও ভারতের সীমান্তবর্তী প্রদেশগুলোর সঙ্গে সৈয়দপুর বিমানবন্দরের সংযোগের সম্ভাবনার আভাসও মিলেছে বহুবার।
অভ্যন্তরীণ থেকে আন্তর্জাতিকে উন্নীত হলে উপমহাদেশের তিনটি দেশের যাত্রীরা ব্যবহার করতে পারবে সৈয়দপুর বিমানবন্দর। তাতে নেপাল, ভুটানও ভারতের সেভেন সিস্টার্স খ্যাত সাতটি রাজ্যের নিকটতম বিমানবন্দরগুলোতে যেতে সময় লাগবেমাত্র ৩০ থেকে ৫০ মিনিট। বাঁচবে সময়, বাড়বে বাণিজ্যের পরিধি।
সৈয়দপুর বিমানবন্দরে ওঠানামা করছে বিমান। ছবি: এখন টিভি
২০১৭ সালে এই বিমানবন্দরকে দেশের পঞ্চম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হিসেবে উন্নীত করার ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই ঘোষণার পর ২০১৯ সালের মার্চে সৈয়দপুর ও দিনাজপুরের পার্বতীপুরে শুরু হয় জমির অধিগ্রহণের কার্যক্রম।
সৈয়দপুর বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপক এ.কে.এম বাহাউদ্দিন জাকারিয়া বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে এটাকে বিমানের আঞ্চলিক অঞ্চল তৈরি করার পরিকল্পনা আছে। আশা করি দ্রুতই সেটা হবে।‘
সৈয়দপুর বিমানবন্দরের পাশাপাশি রাজশাহীর শাহ মখদুম বিমানবন্দরটিও উত্তর জনপদের জন্য এখন আশীর্বাদ। ১৯৮৪ সালে যাত্রা শুরুর পর লোকসানে ২০০৭ সালে বন্ধ হয়ে যায় বিমানবন্দরটি। তার ঠিক ৯ বছর পর ২০১৫ সালে ফের শুরু হয় বিমান চলাচল। এখন প্রতি বছরই বাড়ছে ফ্লাইটের পরিমাণ ও আয়।
গেল অর্থবছরে এই বিমানবন্দর আয় করেছে ২ কোটি ৩৩ লাখ ৭৭ হাজার ৪৬৬ টাকা। সেই সংখ্যা চলতি অর্থবছরে সাড়ে তিন কোটি ছাড়াবে।
রাজশাহী বিমানবন্দর থেকে সপ্তাহে ৩২টি ফ্লাইট পরিচালনা করা হচ্ছে। যেখানে যাত্রী পরিবহন করা হচ্ছে প্রায় ২ হাজার ৪০০ জনেরও বেশি। প্রতিনিয়ত রাজশাহী থেকে বিমানের চাহিদা বাড়তে আছে। এর সাথে এখানকার ব্যবসায়ীদের দাবি আছে কার্গো বিমান চলাচল করানোর জন্য।
বিমানবন্দরটিতে সেবার মান বাড়াতে বাড়ানো হচ্ছে কাউন্টার, বোডিং-গেট, বসানো হচ্ছে আরও একটি স্ক্যানার। আর লাগেজ সরবরাহ সহজ করতে বসানো হবে বেল্ট।
শাহ মখদুম বিমান্দরের ব্যবস্থাপক দিলারা পারভীন বলেন, 'আমাদের একসাথে ২৬০ জন যাত্রী ক্যাপাসিটি ছিল। সেখান থেকে আমরা ৩৭০ জন করবো।'
রাজশাহীর শাহ মখদুম বিমান্দর। ছবি: এখন টিভি
অভ্যন্তরীণ এই বিমানবন্দরটি শুধু রাজশাহী নির্ভর নয়, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর, নওগাঁ, পাবনার যাত্রীসহ ঈশ্বরদীর রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পে কর্মরত দেশী বিদেশি নাগরিকরা ব্যবহার করে।
একইসাথে রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্রের জ্বালানিসহ অন্যান্য সরঞ্জাম ঢাকা হয়ে রূপপুর নিতে সড়ক পথের ঝুঁকি বিবেচনায় রাজশাহী বিমানবন্দর দিয়ে নেবার পরিকল্পনা চলছে। এতে বেবিচক ২ হাজার কোটি টাকার বাজেটও তৈরি করেছে।
উন্নয়ন কার্যক্রম অব্যাহত থাকলে রাজশাহীতে এভিয়েশন খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ব্যবসার দুয়ার খুলবে বলে প্রত্যাশা ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতাদের।
রাজশাহী চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মাসুদুর রহমান রিঙ্কু বলেন, ‘রুপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে আমরা জানতে পারি যে বিদ্যুৎকেন্দ্রের পণ্যগুলো রাজশাহী বিমানবন্দরের মাধ্যমে নিয়ে আসা হচ্ছে। এটা কিন্তু ব্যবসার একটা সম্ভাবনার দুয়ার খুলছে।‘
বিমানবন্দরটির নতুন টার্মিনালটি বাস্তবায়ন হলে বর্তমান টার্মিনালের চেয়ে ১০ গুন যাত্রী এবং ৬ গুন বিমান উড্ডয়ন অবতরণের সক্ষমতা বাড়বে রাজশাহীর। পাশাপাশি বিমানবন্দরটির রানওয়ে সম্প্রসারণেও নীতি নির্ধারকদের সাথে যোগাযোগ করছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা।
উত্তর জনপদ যখন অ্যাভিয়েশন খাতে সম্ভাবনা দেখাচ্ছে। তখন দক্ষিণ-পূর্বের পর্যটন নগরী কক্সবাজার এই খাতে এগিয়েছে বহুদূর। বর্তমানে কক্সবাজার বিমানবন্দর হয়ে প্রতিদিন গড়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত করেন প্রায় ২ হাজার যাত্রী। আর বছরে সেই যাত্রীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৭ লাখের বেশি।
যাত্রী চাহিদা, পর্যটনের অপার সম্ভাবনা এবং বিমানবন্দরটিকে বিশ্বের আকর্ষণীয় রিফুয়েলিং হাব হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন-সম্ভাবনাকে সামনে রেখে চলছে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার কাজ। সমুদ্রের বুকে তৈরি হচ্ছে 'দেশের দীর্ঘতম' রানওয়ে। এগিয়ে চলেছে আন্তর্জাতিক প্যাসেঞ্জার টার্মিনাল নির্মাণের কাজ।
কক্সবাজার হোটেল-মোটেল, গেস্টহাউস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সেলিম নেওয়াজ বলেন, 'নতুন রানওয়েটা সাগরের মধ্যে হয়েছে। এটি আন্তর্জাতিক মানের, অত্যাধুনিক ও নতুনভাবে সাজিয়েছে। এটি সম্পূর্ণ হলে এই বিমানবন্দরে দিনরাত ফ্লাইট ওঠানামা করবে।'
কক্সবাজার বিমানবন্দর। ছবি: এখন টিভি
এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে আধুনিক বিমান চলাচলের সক্ষমতা অর্জনের পাশাপাশি বিভিন্ন দেশ থেকে সরাসরি কক্সবাজার ভ্রমণের সুযোগ পাবেন পর্যটকরা। এতে পর্যটন ব্যবসায় ছাড়াও ইতিবাচক প্রভাব পড়বে সামগ্রিক অর্থনীতিতে।
গেলো বছর এই বিমানবন্দর ব্যবহার করেছেন ৭ লাখ ৫ হাজার ৫৪৬ জন আর২০২৩-২৪ অর্থবছরের এপ্রিল পর্যন্ত আয় হয়েছে প্রায় ১১ কোটি টাকা। এমন প্রেক্ষাপটে বিমানবন্দরটিকে ঘিরে নানা স্বপ্নের কথা জানালেন ব্যবস্থাপক।
কক্সবাজার বিমানবন্দরের গোলাম মোর্তজা হোসেন বলেন, ‘পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের মাঝামাঝি হওয়ায় এখানে অনেক সুবিধা আছে। প্রধানমন্ত্রী এখানে একটা রিফুয়েলিং হাব গড়ে তোলার জন্য উদ্যোগ নিয়েছেন এবং সে অনুযায়ী কাজ চলছে।‘
কক্সবাজার বিমানবন্দরটিকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার কাজে ব্যয় করা হচ্ছে ১ হাজার ৭৯৪ কোটি ৩১ লাখ টাকা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিমানবন্দরে ট্যাক্সিক্যাব ব্যবস্থা, পর্যটন তথ্যকেন্দ্র এবং ব্যবসা তথ্যকেন্দ্র চালুর উদ্যোগ বদলে দিতে পারে গোটা পর্যটন ও ব্যবসা-বাণিজ্যের চিত্র।