সুনামগঞ্জের করচার হাওর পাড়ের কৃষক শাহাব উদ্দিন। মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদে টাকা এনে ৫ একর জমিতে বোরো ধান বুনেছেন। কিন্তু চোখে-মুখে এখন হতাশা আর শঙ্কার ছায়া। কারণ হাওরে বাঁধের কাজ পুরোদমে শুরু হয়নি। উজানের ঢলে ধান ডুবলে তাকে নিঃস্ব হতে হবে।
চাষি শাহাব উদ্দিন বলেন, 'বান্ধের (বাঁধ) কাজ এখনো কিছু হইতাছে না।। সারা কাজেই রইয়া গেছে।'
শাহাব উদ্দিন ছাড়াও সুনামগঞ্জের ৪ লাখ কৃষক একই শঙ্কায় রয়েছে। চলতি মৌসুমে ২ লাখ ২৩ হাজার ২৪৫ হেক্টর জমিতে বোরো ধান চাষ হয়েছে। যেখান থেকে উৎপাদনের লক্ষ্য ১৩ লাখ ৭০ হাজার ২০২ টন। বাজারমূল্য ৪ হাজার ১১০ কোটি টাকা। এখন চাষিরা বলছেন, প্রতি বছরই এই সময়ে বাঁধ নিয়ে তাদের আতঙ্কে থাকতে হয়।
হাওরের কৃষকরা বলেন, 'বান্ধের কাম (বাঁধের কাজ) যদি চৈত্র মাসের আগে না করে তাইলে পানি বান্ধ ভাইঙ্গা লাইবো। প্রত্যেক বছর এই বান্ধের মধ্যে কোটি কোটি টাকা খরচ করা হয়। তারপরেও আমাদের মনের মধ্যে ভয় থাকে।'
আগাম বন্যার হাত থেকে হাওরের ধান রক্ষায় ষাটের দশক থেকে ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণ করা হয়। যে বাঁধগুলো নদীর পানি হাওরে ঢুকতে বাধা দিয়ে থাকে। এতে বোরো ফসল রক্ষা পায়। প্রতিবছরই এসব বাঁধ সংস্কার ও পুননির্মাণের কাজ চলে। কিন্তু শতকোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত বাঁধ কৃষকদের কতটুকু কাজে লাগছে!
বাস্তবতা বলছে, গত পাঁচ বছরে অকাল বন্যায় হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙে ৬০০ কোটি টাকার ধান ভেসে গেছে। এরমধ্যে ২০১৭ সালে নষ্ট হয় ৪৪৬ কোটি, ২০১৮ সালে ৫১ লাখ, ২০১৯ সালে ৭১ কোটি, ২০২২ সালে ৪৯ কোটি ৩৮ লাখ ও ২০২৩ সালে ১ কোটি ৬ লাখ টাকার ধান অকাল বন্যায় ভেসে যায়।
প্রতিবারের মত চলতি বছরেও সুনামগঞ্জের ১২ উপজেলার ৭৩৩টি অংশে ৫৯১ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে। ব্যয় ধরা হয়েছে ১২৫ কোটি টাকা। যদিও কাজ শুরুর একমাস পরেও তেমন অগ্রগতি নেই। বছর বছর শতকোটি টাকা ব্যয়ের নির্মিত বাঁধের গুণগত মান নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।
চাষিরা বলছেন, উজানের ঢল আর অল্প বৃষ্টিতেই বাঁধ ভেঙে যায়। এতে সরকারি টাকা খরচ হলেও দুর্ভোগ থেকে তাদের মুক্তি মেলে না। এখন আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে টেকসই বাঁধ নির্মাণের দাবি।
চাষিরা বলেন, 'হাওরে প্রতি বছরে মাডি (মাটি) ফালানি হয়, রাস্তা বান্ধা হয় তবু আমরা শান্তিতে থাকতাম পারি না, ভিতরে ভয় থাকে। প্রত্যেক বছর বাঁধ তৈরি করে আবার ভেঙ্গেও যায়। ৫০ বছরে সরকারের অনেক অনেক টাকা গেছে। সুন্দর কইরা একবারে বান্ধা হইলে আমরাও নিশ্চিত থাকতাম।'
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, 'বাঁধগুলো স্থায়ী রক্ষণা-বেক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে প্রতিবছর মাটি এনে ভরতে না হয়। কারণ মাটিগুলো আবার বানের পানির সাথে কৃষকের জমিতেই ছড়িয়ে পড়ছে।'
তবে পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে বাঁধ ঝুঁকিমুক্ত রাখতে সাড়ে ৪ হাজার কোটি ব্যয়ে নদী খননের প্রকল্পের পাশাপাশি ১৬ কিলোমিটার স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নিবার্হী প্রকৌশলী মামুন হাওলাদার বলেন, 'আমাদের ব্যয় হয়েছে সাড়ে ৪ হাজার টাকা। আমরা ইতিমধ্যে ২ হাজার টাকা প্রকল্প ব্যয় প্রণয়ন করেছি পর্যায়ে। এখানের নদীগুলোর ড্রেজিং করার কথা সেগুলো আমরা করবোা।'
পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ বিভাগীয় প্রকৌশলী শমসের আলী বলেন, 'সমস্ত কাজগুলোর টেন্ডার হয়ে গেছে। এখন ঠিকাদার নিয়োগ দিয়ে কাজগুলো যথাক্রমে শুরু হবে। এতে প্রায় ১৬ কিলোমিটার স্থায়ী বাঁধ হবে।'
তবে এবারে বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম পাওয়া গেলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলছেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রাশেদ ইকবাল। বলেন, প্রাকৃতিক কারণেও সময়মতো কাজটা শেষ করা যায় না। যদি কোন অনিয়মের অভিযোগ পাই তাহলে আইনানুগভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
গতবছর সুনামগঞ্জের ১২ উপজেলায় ২০৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ফসলরক্ষা বাঁধের কাজ হয়। তারপরও উজানের ঢলে বাঁধ ভেঙে কৃষকের কোটি টাকার ধান তলিয়ে যায়।