আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সক্ষমতা বাড়াতে অনেক আগেই গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ করেছে পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও মিয়ানমার। ভারতও শুরু করেছে গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণের প্রক্রিয়া। দেরিতে হলেও স্বপ্নের গভীর সমুদ্র বন্দরের টার্মিনাল নির্মাণ শুরু করতে যাচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দর।
এক হাজার ২০০ মেগাওয়াটের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ২০২০ সালে নয় হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ১৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের চ্যানেল নির্মাণ করা হলেও নানা জটিলতায় টার্মিনাল নির্মাণকাজ শুরু হয়নি।
গত ১০ মার্চ একনেকে সরকার মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্প অনুমোদন দেয়ার পর সুগম হয় টার্মিনাল নির্মাণের পথ। সময়ক্ষেপণের কারণে মাতারবাড়ি প্রকল্পে খরচ দুই দফায় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৪ হাজার ৩৮১ কোটি টাকায়। প্রথম টার্মিনাল নির্মাণে পুরোটাই অর্থায়ন করবে জাপানি ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি। এরই অংশ হিসাবে জাপানি প্রতিষ্ঠান পেন্টা ওশান এবং থোয়া করপোরেশনের চুক্তি করছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। প্রথম টার্মিনালে থাকবে ৪৬০ মিটার দৈর্ঘ্যের একটি কনটেইনার জেটি ও ৩৩০ মিটার দৈর্ঘ্যের একটি মাল্টি পারপাস জেটি।
বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছেন, ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দরের উপর নির্ভরতা ঘোচাবে মাতারবাড়ি বন্দর। রপ্তানি পণ্য সরাসরি পৌঁছে যাবে ইউরোপ, আমেরিকার বন্দরে। বিশ্বের যেকোনো বন্দর থেকে আমদানি পণ্য নিয়ে এ বন্দরে ভিড়তে পারবে ১৪ মিটার গভীরতার বড় জাহাজ।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব ওমর ফারুক বলেন, '২০৩০ সালের মধ্যেই এটা ইনশাআল্লাহ অপারেশন শুরু হবে। সাত থেকে আট হাজার টিস ধারণক্ষমতাসম্পন্ন জাহাজ আসতে পারবে। এখানে প্রায় ১৩ থেকে ১৪ মিটার ড্রাফট থাকবে। এবং আমাদের ট্রান্সশিপমেন্ট পোর্টের উপর যে নির্ভরতা, সেটি অনেকটা কমে আসবে। এখানে সরাসরি বড় জাহাজগুলো সতে পারবে।'
বন্দর ব্যবহারকারী ব্যবসায়ীদের আশা, গভীর সমুদ্র বন্দর হলে পণ্য খালাস ও পরিবহণ ব্যয় কমবে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ। আগে যেখানে পণ্য পাঠাতে চার সপ্তাহ সময় লাগতো, মাতারবাড়ি বন্দর হলে তা অর্ধেকে নেমে আসবে। বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর পাশাপাশি একশটি অর্থনৈতিক অঞ্চলের চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হবে এই বন্দর। তবে সুফল নিতে টার্মিনাল নির্মাণের পাশাপাশি দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর ব্যবসা বাণিজ্যের আঞ্চলিক হাব হিসাবে মাতারবাড়ি বন্দর ব্যবহারে উৎসাহিত করতে সড়ক রেল ও নৌপথের কার্যকর সংযোগ গড়ে তোলার আহ্বান ব্যবসায়ীদের।
বিজিএমইএ'র সাবেক সহ-সভাপতি নাসিরউদ্দিন চৌধুরী বলেন, 'মাতারবাড়ির খানে ভ্যাসেল আসলে তো হবে না। ওখান থেকে মালামাল কত দ্রুত ডেচপাস করা যায়, ঢাকা পৌঁছাতে পারে, কত দ্রুত উত্তরবঙ্গ বা দক্ষিণাঞ্চলে যেতে পারে সেটি দেখতে হবে। গভীর সমুদ্রবন্দরের সাথে কানেক্টিভিটিটা এমন হতে হবে, যেন খুব দ্রুততার সাথে মালামালগুলো ডেচপাস করা যায়।'
টিকে গ্রুপের পরিচালক জাফর আলম বলেন, 'সময়সাশ্রয়ী হবে মাতারবাড়ি বন্দর। এক্সপোর্টের জন্য এখান থেকে সরাসরি এক্সপোর্ট চলে যাচ্ছে। সেটাও ব্য়য়সাশ্রয়ী এবং সময়সাশ্রয়ী হবে।'
টার্মিনাল নির্মাণ শেষে ২০৩০ সালেই যেন গভীর সমুদ্র বন্দরের বাণিজ্যিক কার্যক্রম চালু করা যায় এজন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কেনাসহ কীভাবে বন্দর পরিচালিত হবে, কারা টার্মিনাল পরিচালনা করবে সব কিছুর জন্য সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নেয়ার আহ্বান বন্দর ব্যবহারকারীদের।
এমএসসি শিপিংয়ের মহাব্যবস্থাপক আজমীর হোসেন চৌধুরী বলেন, 'অনেকক্ষেত্রেই মরা দেখতে পাই যে, টার্মিনাল রেডি হয়ে গেছে কিন্তু অপারেশনে যেতে পারছে না যেহেতু ক্রেন নেই বা হ্যান্ডেলিং ইকুয়েপমেন্টগুলো নেই। এই সমস্যাটা যেন মাতারবাড়ির ক্ষেত্রে না হয়।'
সমীক্ষার তথ্যমতে বছরে দুই থেকে আড়াই বিলিয়ন ডলার রাজস্ব আয়ের জোগান দেবে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর। দু'টি টার্মিনাল নির্মিত হলে বছরে প্রায় তিন মিলিয়ন টিইইউএস কনটেইনার হ্যান্ডলিং করবে এই বন্দর।