অর্থনীতি
0

মূল্যস্ফীতির পাশাপাশি বেড়েছে আয় বৈষম্য

মানিকগঞ্জ

গত দুবছর ধরে মূল্যস্ফীতি নিয়ে কোন সুখবর নেই। আয় বৈষম্যও দিন দিন বাড়ছে। গড় হারে বাড়েনি মজুরি। আসছে বাজেটে মূল্যস্ফীতি সামাল দিতে ব্যর্থ হলে জটিল হতে পারে পুরো অর্থ-সামাজিক কাঠামো। তাই সামাজিক খাতে গুরুত্ব দেয়ায় তাগিদ অর্থনীতিবিদদের।

মৌসুমে ফুরাবার আগেই মোহাম্মদ হোসেনের হিসেব মেলে না। তাতে ছোট মেয়েটির এসএসসি পরীক্ষায় বসা হলো না এবার।

মোহাম্মদ হোসেন বলেন, 'আমি দুইটা মেয়ে বিয়ে দিয়েছি। আরেকটা মেয়ে আছে। টাকার ছোট মেয়েটার অভাবে পড়াতে পারছি না।'

বেড়েছে সারের দাম, সেচেও এবার পানি লেগেছে বেশি, দামও ১০০ টাকা বেড়েছে। কৃষকের ঘামের দাম বাদ দিয়েও এবার ধানের দাম পরের বীজতলা তৈরির উপযোগ সৃষ্টিতে ব্যর্থ। শহরে মানবসৃষ্ট উষ্ণতায় এবার বৃষ্টির হাহাকার লাগলেও এই মুহূর্তে তাই উলটো প্রার্থনা কৃষকদের।

তিনি বলেন, 'আগে ভালো ছিল। গতবার লাভবান ছিলাম কিন্তু এবার ৪০ হাজার টাকার মতো লোকসান হয়েছে।'

নিজের খরচ মিটিয়ে সঞ্চিত অর্থ থেকে মানুষ বিনিয়োগ করতে উদ্বুদ্ধ হন। ব্যক্তিমালিকানায় পল্লি অঞ্চলে এভাবেই গড়ে ওঠে ছোট ছোট উদ্যোগ। আব্দুল আলীমের জুতোর কারখানার বয়স ৫ বছর। কিন্তু গত দু'বছরে মূল্যস্ফীতির চাপে কাঁচামাল, বিদ্যুৎ খরচ, কারখানা খরচ, কর্মচারীদের বেতন, পরিবহনের খরচ বেড়েছে ৪০ শতাংশ।

আব্দুল আলীম বলেন, 'চলতি বছর এই সময়ে অর্ডার পেয়েছি ১০ ডজন আর একই সময়ে গতবছর অর্ডার ছিল ৩০ ডজন। আগামী বছর হয়তো ভালো হতে পারে। যদি বাজেট থাকে তাহলে দিবো আর নয়তো উঠায় দিবো। এছাড়া কিছু করার নেই।'

আমদানিনির্ভর খাদ্যপণ্য ছাড়াও দেশীয় উৎপাদিত খাদ্যেরও দাম হয়েছে চওড়া। মজুরি মূল্যের সেখানে খুব বেশি উন্নতি না হলেও পোলট্রি পণ্যের দাম বাড়ায় প্রভাব পড়েছে মুরগি ও মাছের বাজারে। সেখানেও দাম পোষাতে না পেরে অনেকে ব্যবসা বন্ধ করেছেন। সম্প্রতি বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ডেভলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) গবেষণায় উল্লেখ করে, ডিসেম্বরে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি সামগ্রিক ছিল ১২ শতাংশ । তবে ১৫ শতাংশ মূল্যস্ফীতির চাপে ছিল দরিদ্র জনগোষ্ঠী।

বিআইডিএস’র গবেষণা পরিচালক ড. এম এম জুলফিকার আলী বলেন, 'আমাদের রিয়েল ইনকাম কমে যাচ্ছে। দুই বছর আগে একজন কৃষকের যে মজুরি ছিল তা দিয়ে যে কয় কেজি চাল কিনতে পারতো তা এখন পারছে না।'

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য বলছে, বছরের শেষ প্রান্তিকে এপ্রিলে সামগ্রিক গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৯.৭৪ শতাংশ। যেখানে খাদ্যপণ্যে ১০.২২ শতাংশ। খাদ্য নয় এমন পণ্যে মূল্যস্ফীতি ৯.৩৪ শতাংশ। তবে সার্বিক মূল্যস্ফীতির কারণে বেশি চাপে ছিলেন পল্লি এলাকার মানুষ। শহর থেকে ০.৪৬ শতাংশ বেশি ছিল গড় মূল্যস্ফীতি। ০.৬ শতাংশ বেশি খাদ্যপণ্যে। এবং ভোগ্যপণ্য ছাড়া অন্যান্য পণ্যেও পল্লি অঞ্চলের মানুষকে ০.৫০ শতাংশ বেশি খরচ করতে হয়েছে।

অর্থনীতিবিদ এম এম আকাশ বলেন, 'বাংলাদেশে এই মূল্যস্ফীতির কারণে ৪ কোটি লোকের খাদ্য নিরাপত্তা ক্ষুণ্ন হতে যাচ্ছে। আমরা এইটাকে বাজার ভিত্তিক প্রতিযোগিতার মাধ্যমে কোনোভাবেই নিশ্চিত করতে পারছি না। এইটার একমাত্র উপায় সরকার যদি বাজারে মূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।'

বাংলাদেশ ব্যাংকের চার অর্থ বছরের হিসেব বলছে ২০২০-২১ ও ২১-২২ অর্থ বছরে ০.৫৯ শতাংশ মূল্যস্ফীতি থাকলেও এক লাফে ২০২২-২৩ সালে প্রায় তিন শতাংশ বাড়ে যা ২০২৪ অর্থ বছরে এসে যোগ হয় আরও এক শতাংশ। বিআইডিএস এর গবেষণা বলছে, যে হারে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে সে হারে বাড়েনি মজুরি। তাই আসছে বাজেটে মূল্যস্ফীতি কমানোর সাথে মজুরি বৃদ্ধির তাল ঠিক না রাখলে সার্বিক অর্থনীতি জটিল হয়ে উঠবে।

সিপিডি বিশেষ ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, 'মূল চালিকাটা হতে হবে প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান দিয়ে নিম্ন আয়ের মানুষের আয়ের ব্যবস্থা করা। তারপরেও কেউ যদি থেকে যায় শারীরিকভাবে অক্ষম, সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন এই সমস্ত মানুষের জন্য সামাজিক সুরক্ষা দরকার।'

আর্থসামাজিক বিশ্লেষক ও অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, আসছে বাজেটে সামাজিক সুরক্ষাকে গুরুত্বে দিতে হবে। গুরুত্ব দিতে হবে কৃষি উৎপাদন ও প্রান্তিক বিনিয়োগ ও সামষ্টিক অর্থনীতিতে। এছাড়া জরুরি এই সময়ে 'এডহক' ভিত্তিতে ব্যষ্টিক অর্থনীতির নীতি তৈরি করতেও গতানুগতিক ধারায় না গিয়ে পরিসংখ্যান ও গবেষণার তথ্য উপাত্ত ও খাত সংশ্লিষ্টদের প্রাধান্য দিয়ে অংশগ্রহণমূলক নীতি নিতে হবে।

ইএ

এই সম্পর্কিত অন্যান্য খবর