কুমিল্লা এখন ‘অটোরিকশার নগরী’; অব্যবস্থাপনায় হারাচ্ছে বাসযোগ্যতা

কুমিল্লার কেন্দ্রীভূত এলাকা ও দক্ষিণের এলাকা | ছবি: এখন টিভি
0

প্রাচীন ইতিহাস ও সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের শহর কুমিল্লা একসময় পরিচিত ছিল ‘ব্যাংক ও ট্যাংকের শহর’ হিসেবে। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই চিত্র অনেকটাই বদলে গেছে। বর্তমানে নিয়ন্ত্রণহীন অটোরিকশা, যানজট, জলাবদ্ধতা ও নগর অব্যবস্থাপনায় কুমিল্লা দিনদিন হারাচ্ছে তার বাসযোগ্যতা। ৫৩ দশমিক ৪ বর্গ কিলোমিটারের কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের প্রকৃত নগরায়ন সীমাবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছে মাত্র ১০ থেকে ১২ বর্গ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে। বাকি অংশ মূলত ফসলি জমি ও প্রত্যন্ত এলাকা। একই জায়গায় বাসস্থান, বাণিজ্য, পরিবহন এবং প্রশাসনিক কার্যক্রমের অস্বাভাবিক ঘনত্ব সৃষ্টি করেছে নানাবিধ দুর্ভোগ। এ অবস্থায় নগর পরিকল্পনাবিদ থেকে শুরু করে সাধারণ নাগরিকরা বলছেন, কুমিল্লাকে টেকসই ও বাসযোগ্য শহর হিসেবে গড়ে তুলতে বিকেন্দ্রীকরণই এখন সময়ের দাবি।

সুউচ্চ দালান নয়, বরং একটি আধুনিক; পরিকল্পিত ও সাজানো শহর গড়ার স্বপ্ন নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় কুমিল্লা সিটি করপোরেশন।তবে এক দশক পর বাস্তবচিত্র বলছে ভিন্ন কথা।

সরু সড়ক, ঘিঞ্জি বাজার, অনিয়ন্ত্রিত তিন চাকার বাহনের দৌরাত্ম্য, এলোমেলো ইউ-টার্ন আর দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় মিনিটের পথও কখনো অতিক্রম করে ঘণ্টায়। নিয়মবহির্ভূত ভবন নির্মাণের সঙ্গে জলাবদ্ধতা, সড়ক-ফুটপাত দখল আর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিশৃঙ্খলায় নাকাল নগরবাসী।

স্থানীয়দের অভিযোগ, লুটপাট আর নগর ভবনের সঠিক পরিকল্পনার অভাবে উন্নয়নের প্রতিশ্রুতির শহর আজ পরিণত হয়েছে অব্যবস্থাপনা আর দুর্ভোগের নগরীতে।

কেন্দ্রীভূত এলাকার বাসিন্দারা জানান, অটোরিকশার জন্য তারা প্রতিনিয়তই বিভিন্ন সমস্যার মুখে পড়ছেন। ফুটপাত না থাকায় চলাচলে সমস্যা হয়। রিকশা ছাড়া তাদের কাছে বিকল্প আর কোনা বাহন নেই বলে জানান তারা।

এদিকে, কৃষিজমি ও প্রত্যন্ত অঞ্চল নিয়ে গঠিত নগরীর দক্ষিণের ৯টি ওয়ার্ডের বাসিন্দারা অবহেলা ও বৈষম্যের শিকার হয়ে দাবি করেন, সেবার প্রত্যাশায় নিয়মিত ফি ও ট্যাক্স পরিশোধ করলেও সুপেয় পানির সরবরাহ, ড্রেনেজ, সড়ক উন্নয়নসহ সবকিছু থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন একদশক ধরে।

দক্ষিণের বাসিন্দারা জানান, ভোর হতে না হতেই গ্যাস চলে যায়। বিদ্যুৎ ব্যবস্থাও ভালো নয়। যেসকল সুবিধা পাওয়ার কথা তারা তা পাচ্ছেন না বলে জানান তারা।

বহুমাত্রিক এই সংকটের মূল কারণ অতিরিক্ত জনসংখ্যা আর কেন্দ্রীভূত নগরব্যবস্থা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টেকসই নগরে পরিণত করতে মাস্টার প্ল্যানের মাধ্যমে শহর বিকেন্দ্রীকরণই একমাত্র পথ।

কুমিল্লা লেখক ও সম্পাদক আবুল কাশেম হৃদয় বলেন, ‘আমাদের পরিকল্পিতভাবে কাজ করতে হবে। শহরটিকে দক্ষিণ দিকে নিয়ে যেতে হবে। যেহেতু শহরের দক্ষিণে বাজার আছে। সেখানে আবাসিক এলাকা গড়ে উঠছে।’

আরও পড়ুন:

কুমিল্লা সংগঠক খায়রুল আনাম রায়হান বলেন, ‘অনেক কৃষি জায়গা পড়ে আছে। সেগুলোও সিটি করপোরেশনের অন্তর্ভুক্ত করে এ নগরীকে বড় করতে পারে।’

আর সড়ক সম্প্রসারণের প্রস্তাবনা রয়েছে দাবি করে সিটি করপোরেশন বলছে, বাদ পড়া গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলগুলোকে সিটিতে যুক্ত করার সঙ্গে ওয়ার্ড ভিত্তিক সেবা বাড়ানো এবং মাস্টার প্ল্যানের মাধ্যমে ভারসাম্য আসবে নগর পরিকল্পনায়।

কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আবু সায়েম ভূইঁয়া বলেন, ‘যদি আমরা উন্নয়নের কিছু পরিকল্পনাগুলো দক্ষিণে ট্রান্সফার করে নিয়ে যেতে পারি, স্ট্যাটেলাইট টাওউনের মতো। তখন এ জিনিসগুলো হবে না।’

কুমিল্লা সিটি করপোরেশন মেয়র মো. শাহ আলম বলেন, ‘যদি কোনো নগরকে বড় করা হয় তাহলে যেই মূল নগরকে কেন্দ্র করে নগরীটি গড়ে ওঠে তার আশপাশে কিছু তুলনামূলক কম উন্নত এলাকা থাকে। মূল শহরের সঙ্গে ওই অঞ্চলের একটি পার্থক্য থাকে। একটু সময় লাগবে সমানভাবে দুটি দৃশ্যমান করে তোলার জন্য।’

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বিকেন্দ্রীকরণে ঢাকা-চট্টগ্রামের মাঝের এই শহরে সৃষ্টি হবে নতুন নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চল। এতে বাড়বে কর্মসংস্থানও।

কুমিল্লাকে বাঁচাতে দরকার সঠিক পরিকল্পনা, রাজনৈতিক সদিচ্ছা আর দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান। বিকেন্দ্রীকরণ হলে শুধু মূল শহরের চাপই কমবে না; সবার জন্য নিশ্চিত হবে সমান সেবা, সমান উন্নয়ন, আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং বাসযোগ্য কুমিল্লা। সময় এসেছে; নগরকে এক চৌহদ্দিতে আটকে না রেখে প্রসারিত করার, ভারসাম্য আনার এবং কুমিল্লাকে একটি উন্নত, মানবিক, পরিকল্পিত মহানগরীতে রূপ দেয়ার।

এফএস