রজবের চাঁদ দেখা গেছে, শবে মেরাজ ১৬ জানুয়ারি

পবিত্র শবে মেরাজ কবে ২০২৬
পবিত্র শবে মেরাজ কবে ২০২৬ | ছবি: এখন টিভি
1

বাংলাদেশের আকাশে ১৪৪৭ হিজরি সনের পবিত্র রজব মাসের চাঁদ (Moon of Rajab Month) দেখা গেছে। ফলে আজ সোমবার (২২ ডিসেম্বর) থেকে পবিত্র রজব মাস গণনা শুরু হচ্ছে। সেই হিসেবে মুসলিম উম্মাহর অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ও মহিমান্বিত রাত পবিত্র শবে মেরাজ (Holy Shab-e-Meraj) আগামী ১৬ জানুয়ারি (শুক্রবার) দিবাগত রাতে পালিত হবে।

গতকাল রোববার (২১ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় ইসলামিক ফাউন্ডেশন বায়তুল মোকাররম সভাকক্ষে চাঁদ দেখা কমিটির সভায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন।

একনজরে: পবিত্র শবে মেরাজ ২০২৬

  • চাঁদ দেখা: ২১ ডিসেম্বর ২০২৫, রোববার (১৪৪৭ হিজরি)।
  • রজব মাস শুরু: ২২ ডিসেম্বর ২০২৫, সোমবার।
  • শবে মেরাজের তারিখ: ১৬ জানুয়ারি ২০২৬, শুক্রবার দিবাগত রাত।
  • নির্ধারক: ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটি।
  • মূল ঘটনা: মহানবী (সা.)-এর ঊর্ধ্বাকাশে গমন ও আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ।
  • প্রধান উপহার: উম্মতের জন্য পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ হওয়া।
  • বিশেষ গুরুত্ব: রমজান মাসের আগমনী বার্তা ও ইবাদতের প্রস্তুতি।

চাঁদ দেখা কমিটির সিদ্ধান্ত (Decision of Moon Sighting Committee)

উপদেষ্টা জানান, দেশের সব জেলা প্রশাসন, আবহাওয়া অধিদপ্তর এবং মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী রজব মাসের চাঁদ দেখার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালকসহ সংশ্লিষ্ট কমিটির সদস্যরা দীর্ঘ পর্যালোচনার পর এই ঘোষণা (Official Announcement) প্রদান করেন।

আরও পড়ুন:

শবে মেরাজের তাৎপর্য (Significance of Shab-e-Meraj)

ইসলামি বিধান অনুযায়ী, রজব মাসের ২৬ তারিখ দিবাগত রাতটি মুসলিমদের কাছে অত্যন্ত মহিমান্বিত। এই রাতেই বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) সাত আসমান পেরিয়ে মহান আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করেন, যা ইতিহাসে মেরাজুন্নবী (Miraj-un-Nabi) নামে পরিচিত। এই রাতেই মুসলিম উম্মাহর জন্য উপহার হিসেবে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ (Five Times Prayer) ফরজ করা হয়।

সম্মানিত চার মাস ও রমজানের প্রস্তুতি (Sacred Months and Ramadan Preparation)

ইসলামি ক্যালেন্ডারে রজব, জিলকদ, জিলহজ ও মহররম—এই চারটি মাসকে বিশেষ মর্যাদা (Special Honor/Sacred Months) দেওয়া হয়েছে। এই মাসগুলোতে যুদ্ধবিগ্রহ ও অন্যায় থেকে বিরত থাকা ইবাদতের অংশ। উল্লেখ্য যে, রজব মাস শুরু হওয়ার মাধ্যমেই মূলত পবিত্র রমজান মাসের (Holy Ramadan) ক্ষণগণনা শুরু হয়ে যায়। সাধারণত রজব শুরু হওয়ার দুই চান্দ্র মাস পরেই রমজান মাস শুরু হয়।

আরও পড়ুন:

শবে মেরাজের বিস্তারিত তাৎপর্য (Detailed Significance of Shab-e-Meraj)

ইসলামি ইতিহাস ও আকিদায় শবে মেরাজ বা মেরাজুন্নবী (Miraj-un-Nabi) একটি অলৌকিক ও যুগান্তকারী ঘটনা। নবুয়তের একাদশ বর্ষের রজব মাসের ২৬ তারিখ দিবাগত রাতে মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় হাবিব হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে এক বিশেষ ভ্রমণের মাধ্যমে নিজের সান্নিধ্যে নিয়ে যান। এই সফরের তাৎপর্য কয়েকটি প্রধান ভাগে বিভক্ত:

পার্থিব ও অপার্থিব ভ্রমণ (Al-Isra and Al-Mi'raj): মেরাজের দুটি অংশ রয়েছে। প্রথম অংশ 'ইসরা', যা মক্কার মসজিদুল হারাম থেকে ফিলিস্তিনের মসজিদুল আকসা পর্যন্ত ভ্রমণ। দ্বিতীয় অংশ 'মেরাজ', যা বায়তুল মোকাররম থেকে ঊর্ধ্বাকাশে আল্লাহর আরশ পর্যন্ত ভ্রমণ। এই ভ্রমণ প্রমাণ করে যে, আল্লাহর কুদরতে সময়ের সীমাবদ্ধতা ও মহাজাগতিক দূরত্ব কোনো বাধা নয়।

পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ উপহার (Gift of Five Times Prayer): মেরাজের সবচেয়ে বড় তাৎপর্য হলো উম্মতে মোহাম্মদীর জন্য পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ (Five Times Daily Prayer) ফরজ হওয়া। মহান আল্লাহ সরাসরি নবীজিকে এই উপহার দেন। এজন্য নামাজকে 'মুমিনের মেরাজ' বলা হয়। মেরাজের রাত আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, নামাজের মাধ্যমেই বান্দা আল্লাহর সবচেয়ে নিকটবর্তী হতে পারে।

নবীগণের ইমামতি (Imamate of all Prophets): মসজিদুল আকসায় নবীজি (সা.) পূর্ববর্তী সকল নবী-রাসূলের ইমামতি করেন। এটি বিশ্বনবীর শ্রেষ্ঠত্ব এবং সকল আসমানি ধর্মের মূল বার্তার একত্বের প্রতীক।

জান্নাত ও জাহান্নাম পরিদর্শন (Observation of Heaven and Hell): এই রাতে নবীজি (সা.)-কে জান্নাতের নিয়ামত এবং জাহান্নামের ভয়াবহ আজাব দেখানো হয়। এটি মানুষের কর্মফল সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করে এবং পরকালের প্রতি বিশ্বাসকে আরও সুদৃঢ় করে।

ধৈর্য ও পুরস্কার (Reward of Patience): মেরাজ সংগঠিত হয়েছিল নবীজির জীবনের কঠিনতম সময়ে। যখন তিনি মক্কার কাফেরদের অত্যাচার এবং প্রিয়তমা স্ত্রী খাদিজা (রা.) ও চাচা আবু তালিবকে হারিয়ে শোকাচ্ছন্ন ছিলেন। এই মিরাজ ছিল আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর প্রিয় রাসূলের জন্য এক বিশেষ সান্ত্বনা ও উচ্চ মর্যাদার স্বীকৃতি।

আরও পড়ুন:

শবে মেরাজ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ হাদিস (Hadith Regarding Shab-e-Meraj)

নামাজ উপহারের হাদিস: হযরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, মেরাজের রাতে নবীজি (সা.)-এর ওপর প্রথমে ৫০ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করা হয়েছিল। এরপর তা কমিয়ে ৫ ওয়াক্ত করা হয়। তখন আল্লাহ তাআলা বলেন, "হে মুহাম্মদ! আমার কথার কোনো রদবদল নেই। এই ৫ ওয়াক্ত পড়লেই তুমি ৫০ ওয়াক্তের সওয়াব পাবে।" (সহিহ বুখারি ও মুসলিম)।

জান্নাত ও জাহান্নাম দর্শন: নবীজি (সা.) বলেন, "মেরাজের রাতে আমি জান্নাত ও জাহান্নাম পরিদর্শন করলাম। আমি জান্নাতের ভেতরে মুক্তার প্রাসাদ দেখলাম এবং এর মাটি ছিল কস্তুরীর মতো সুগন্ধি।" (সহিহ বুখারি)।

সিদরাতুল মুনতাহা ভ্রমণ: হাদিসে বর্ণিত আছে, নবীজি (সা.)-কে সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়, যা সপ্তম আকাশে অবস্থিত। সেখানে তিনি আল্লাহর নূর ও কুদরতের অভাবনীয় নিদর্শনাবলী প্রত্যক্ষ করেন।

বোরাক ও জিবরাঈল (আ.): হযরত জিবরাঈল (আ.) একটি সাদা রঙের সওয়ারি নিয়ে আসেন যার নাম ছিল 'বোরাক'। এটি চোখের পলকে দৃষ্টির সীমানা অতিক্রম করতে পারত। নবীজি (সা.) এই বোরাকে চড়েই মসজিদুল আকসা থেকে ঊর্ধ্বাকাশে গমন করেন।

পূর্ববর্তী নবীদের সাথে সাক্ষাৎ: মেরাজের রাতে নবীজি (সা.) বিভিন্ন আসমানে হযরত আদম (আ.), হযরত ঈসা (আ.), হযরত ইয়াহইয়া (আ.), হযরত ইউসুফ (আ.), হযরত ইদ্রিস (আ.), হযরত হারুন (আ.), হযরত মুসা (আ.) এবং হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর সাথে সাক্ষাৎ ও কুশল বিনিময় করেন।

এই হাদিসগুলো প্রমাণ করে যে, শবে মেরাজ কেবল একটি অলৌকিক ভ্রমণ ছিল না, বরং এটি ছিল মুসলিম উম্মাহর ইবাদত ও আকিদার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।

আরও পড়ুন:

পবিত্র শবে মেরাজ ২০২৬ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নোত্তর-FAQ

প্রশ্ন: ২০২৬ সালের পবিত্র শবে মেরাজ কত তারিখে?

উত্তর: বাংলাদেশের আকাশে রজব মাসের চাঁদ দেখা যাওয়ায় আগামী ১৬ জানুয়ারি ২০২৬ (শুক্রবার) দিবাগত রাতে পবিত্র শবে মেরাজ পালিত হবে।

প্রশ্ন: শবে মেরাজ কোন মাসে পালন করা হয়?

উত্তর: হিজরি সনের রজব মাসের ২৬ তারিখ দিবাগত রাতে শবে মেরাজ পালন করা হয়।

প্রশ্ন: ২০২৬ সালে কত হিজরি সনের শবে মেরাজ পালিত হবে?

উত্তর: ২০২৬ সালে ১৪৪৭ হিজরি সনের পবিত্র শবে মেরাজ পালিত হবে।

প্রশ্ন: শবে মেরাজ কি সরকারি ছুটি?

উত্তর: বাংলাদেশে সাধারণত শবে মেরাজ উপলক্ষে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কিছু ক্ষেত্রে ঐচ্ছিক ছুটি থাকে, তবে এটি সাধারণ সরকারি ছুটির (General Holiday) অন্তর্ভুক্ত নয়।

প্রশ্ন: শবে মেরাজের রাতে নামাজের নিয়ম কী?

উত্তর: এই রাতে নামাজের কোনো নির্দিষ্ট বা ধরাবাঁধা নিয়ম নেই। অন্যান্য নফল নামাজের মতোই দুই রাকাত করে যত খুশি নফল নামাজ পড়া যায়।

প্রশ্ন: শবে মেরাজ কেন পালন করা হয়?

উত্তর: এই রাতে মহানবী (সা.) মহান আল্লাহর বিশেষ আমন্ত্রণে ঊর্ধ্বাকাশে গমন করেছিলেন এবং আল্লাহর দিদার লাভ করেছিলেন। এই ঐতিহাসিক ঘটনাকে স্মরণ করেই শবে মেরাজ পালন করা হয়।

প্রশ্ন: শবে মেরাজের রাতে কি রোজা রাখা যায়?

উত্তর: শবে মেরাজের পরের দিন অর্থাৎ ২৭শে রজব নফল রোজা রাখা অনেক সওয়াবের কাজ হিসেবে গণ্য করা হয়। তবে এটি বাধ্যতামূলক নয়।

প্রশ্ন: শবে মেরাজের রাতে ৫ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ হয়েছিল কি?

উত্তর: হ্যাঁ, মেরাজের এই মহিমান্বিত রাতেই উম্মতে মোহাম্মদীর জন্য উপহার হিসেবে মহান আল্লাহ ৫ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করে দেন।

প্রশ্ন: শবে মেরাজের বিশেষ কোনো দোয়া আছে কী?

উত্তর: নির্দিষ্ট কোনো দোয়া নেই। তবে এই রাতে বেশি বেশি দরুদ শরিফ, ইস্তেগফার এবং নফল ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে দোয়া করা যায়।

প্রশ্ন: শবে মেরাজ এবং মেরাজুন্নবী কি একই?

উত্তর: হ্যাঁ, শবে মেরাজ এবং মেরাজুন্নবী মূলত একই ঘটনাকে বোঝায়। 'শবে মেরাজ' মানে মেরাজের রাত আর 'মেরাজুন্নবী' মানে নবীর মেরাজ বা ঊর্ধ্বগমন।

প্রশ্ন: মেরাজের রাতে নবীজি (সা.) কোন সওয়ারিতে উঠেছিলেন?

উত্তর: নবীজি (সা.) বিদ্যুৎগতি সম্পন্ন বিশেষ সওয়ারি 'বোরাক'-এ চড়ে মেরাজ গমন করেছিলেন।

প্রশ্ন: শবে মেরাজ পালনের ফজিলত কী?

উত্তর: এই রাতটি ইবাদত-বন্দেগির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি রমজান মাসের আগমনী বার্তা দেয় এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভের একটি বিশেষ সুযোগ তৈরি করে।

প্রশ্ন: শবে মেরাজ নিয়ে কোরআনে কী বলা হয়েছে?

উত্তর: পবিত্র কোরআনের সূরা বনী ইসরাইলের ১ নম্বর আয়াতে মেরাজের প্রথম অংশ (ইসরা) অর্থাৎ মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত ভ্রমণের বর্ণনা স্পষ্টভাবে দেওয়া হয়েছে।

প্রশ্ন: শবে মেরাজের রাতে উম্মতদের জন্য বড় উপহার কী ছিল?

উত্তর: মেরাজের রাতে উম্মতদের জন্য সবচেয়ে বড় উপহার ছিল নামাজ। এছাড়া সূরা বাকারার শেষ দুই আয়াতও এই সফরের অন্যতম উপহার হিসেবে ধরা হয়।

প্রশ্ন: রজব মাস শুরুর কত দিন পর শবে মেরাজ হয়?

উত্তর: রজব মাস শুরু হওয়ার ২৬ দিন পর ২৬ তারিখ দিবাগত রাতে শবে মেরাজ অনুষ্ঠিত হয়।

এসআর