ক্যান্ডিডা অরিসে আইসিইউতে নীরব মৃত্যুর ছায়া: শনাক্তে অক্ষম ৯৫% ইউনিট, অকার্যকর অ্যান্টিফাংগাল

ভাইরাস ও আইসিইউতে রোগী ভর্তি
ভাইরাস ও আইসিইউতে রোগী ভর্তি | ছবি: এখন টিভি
0

আইসিইউতে প্রাণঘাতী ছত্রাক ক্যান্ডিডা অরিসে আক্রান্তের ৯০ শতাংশই প্রাণ হারাচ্ছে। দেশের ৯৫ শতাংশ এনআইসিইউ ও আইসিইউ ক্যান্ডিডা অরিস শনাক্তে অক্ষম। হাতে গোনা কয়েকটি ল্যাবে নির্ণয় করা সম্ভব হলেও এ ছত্রাক নির্মূলে ব্যর্থ প্রচলিত অ্যান্টিফাংগাল ওষুধ। বিশেষজ্ঞদের মতে, মানহীন নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র এবং যত্রতত্র অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহারের কুফল এ নীরব প্রাণহানির মূলে।

ক্যানডিডা অরিস, বিশ্বে ছড়িয়ে পড়া ওষুধ প্রতিরোধী নতুন সুপারবাগ। এনআইসিইউ ও আইসিইউতে থাকা এ প্রাণঘাতী ছত্রাক প্রাণ কেড়ে নিতে পারে শিশু ও পূর্ণ বয়স্ক মানুষের। সম্প্রতি আইসিডিডিআরবির একটি গবেষণার ফলাফলে বাংলাদেশেও এর প্রমাণও মিলেছে। দেশের একটি সরকারি ও একটি বেসরকারি হাসপাতালের এনআইসিইউতে ভর্তি থাকা ৩৭৪টি নবজাতকের মধ্যে গবেষণা চালিয়ে ৩২ জনের ত্বকে ক্যান্ডিডা অরিসের উপস্থিতি পাওয়া যায়।

আইসিডিডিআরবি এএমআর সহযোগী বিজ্ঞানী ও ইউনিট প্রধান ডা. ফাহমিদা চৌধুরী বলেন, ‘ক্যান্ডিডা অরিস হলে ভবিষ্যতে ইনফেকশন হতে পারে। ইনফেকশন হলে প্রাণঘাতী হতে পারে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে। গ্লোবালি ৭০ শতাংশ প্রাণঘাতী হলেও বাংলাদেশে ৯০ শতাংশ হার রয়েছে।’

আইসিডিডিআরবির আরও একটি গবেষণায় ক্যান্ডিডা অরিসের রক্তের ইনফেকশনে আক্রান্ত ১৩ জনের মধ্যে ১০ জনের মৃত্যু হয়। হতাশার খবর হলো, গবেষণার প্রয়োজন ছাড়া ক্যান্ডিডা অরিস নিয়ে দেশের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রগুলোতে তেমন কারো মাথাব্যথা নেই। একইসঙ্গে দেশের দুএকটি হাসপাতাল ছাড়া এটি নির্ণয়ের ল্যাবও নেই।

গবেষণায় আরও উঠে আসে, ক্যান্ডিডা অরিস নামের এ ছত্রাকের বিরুদ্ধে প্রথম সারির অ্যান্টিফাঙ্গাল ফ্লুকোনাজোল ওষুধ কাজ করছে না। সরকারী হাসপাতালে সরবরাহ করা প্রচলিত অ্যান্টি ফাংগাল ওষুধের মাধ্যমে এই ছত্রাকের মৃত্যু সম্ভব হচ্ছে না। দেশের প্রতিটি এনআইসিইউ বা আইসিইউতে বছরে কত শিশু ও প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ আক্রান্ত বা এরইমধ্যেই মৃত্যুর শিকার হয়েছে তার কোনো হিসেব নেই কারো কাছেই।

আইসিডিডিআরবি সিনিয়র রিসার্চ ইনভেস্টিগেটর তানজীর আহমেদ শুভ বলেন, ‘যেগুলো ওষুধ কাজ করে সেগুলোর দেখা যাচ্ছে অনেক দাম এবং সেগুলো সবসময় খুব একটা অ্যাভেলঅ্যাবেল থাকে না। পেসেন্টের ব্যয় বহন করা অনেক কঠিন হয়ে যায়। আরেকটি সমস্যা হলো আমি যদি না জেনে এগুলো ব্যবহার করতে থাকি তখন এগুলোও আর কাজ করবে না।’

আরও পড়ুন:

বেসরকারি ও বিশেষ করে সরকারি হাসপাতালের এনআইসিইউ ও আইসিইউতে রোগীর অ্যাটেনডেন্টদের অবাধ প্রবেশ। জীবাণু রোধে অধিকাংশে সেন্টারে শুধুমাত্র হেক্সাজলের ব্যবহার, ক্লিনার থেকে চিকিৎসক সবার একই রকম গাইডলাইন মেনে না চলা, প্রতিটি মুমূর্ষু রোগী নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে প্রবেশ ও ছুটির সময় গভীরভাবে জীবাণুমুক্ত না করার প্রবণতার সঙ্গে ক্যান্ডিডা অরিসের উপস্থিতি বাড়ার অন্যতম প্রধান কারণ নির্বিচারে অ্যান্টিফাঙ্গাল ওষুধের ব্যবহার।

আইসিডিডিআরবি সিনিয়র রিসার্চ ইনভেস্টিগেটর আরও বলেন, ‘সবচেয়ে ইম্পরট্যান্ট হলো হাসপাতালের সংক্রামক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে জোরদার করা।’

এ গবেষণার আগেই রাজধানীর আজগর আলী হাসপাতাল দুই বছরের ব্যবধানে তাদের এনআইসিইউ ও আইসিইউতে ৫ জনের শরীরে ক্যান্ডিডা অরিসের উপস্থিতি নিশ্চিত করে যাদের মধ্যে একজনের মৃত্যু হয়েছে। তখনও আইসিডিডিআরবির গবেষণার ফল প্রকাশ হয়নি। মাইক্রোবায়োলোজিস্ট ডা. মোরশেদার মতে, উন্নত মানের ল্যাব ও মাইক্রোবায়োলোজিস্ট ও আইসিইউ বিশেষজ্ঞের সহায়তায় ক্যান্ডিডা অরিসের উপস্থিতি বের করা সম্ভব যে সক্ষমতা দেশের ৯০ শতাংশ নিবিড় পরিচর্যা নেই।

আজগর আলী হাসপাতাল মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের সিনিয়র কনসালটেন্ট অধ্যাপক ডা. মুর্শিদা আক্তার বলেন, সব থেকে বেশি ছড়ায় ইনভাইরনমেন্ট থেকে। ইনভাইরনমেন্ট ক্লিনিংয়ের ওপর জোর দিতে হবে। একটি র‌্যাপিড ডাইগোনসিস হতে হবে।’

আজগর আলী হাসপাতাল ক্রিটিক্যাল কেয়ার মেডিসিন বিভাগের কনসালটেন্ট ডা. মো. মতিউল ইসলাম বলেন, ‘আমরা সঙ্গে সঙ্গেই ওই বেডে অন্য পেসেন্টকে দেই না। তার আগে আমরা ব্রেক দেই। পেসেন্টের বেডগুলো ডিপক্লিন করি। অন্য হাসপাতাল থেকে আমাদের এখানে আসলে আমরা প্রথমে অবজার্ভেশনে রাখি পরে তাকে নর্মাল পেসেন্ট হিসেবে ট্রিট করি।’

সম্ভাব্য মৃত্যু ঠেকাতে দেশের সকল আইসিইউ এনআইসিইউতে কঠোর নজরদারি ও মানহীন সেন্টার বন্ধের সুপারিশ দেন বিশেষজ্ঞরা। তবে ধীরে ধীরে ক্যান্ডিডা অরিস নির্ণয়ের সক্ষমতা ও কার্যকরী ওষুধ সরবরাহের আহ্বান তাদের।

এফএস