ভূমিকম্পে ঢাকার যেসব এলাকা সবচেয়ে বেশি ও কম ঝুঁকিপূর্ণ

ভূমিকম্পে ঢাকার যেসব এলাকা সবচেয়ে বেশি ও কম ঝুঁকিপূর্ণ
ভূমিকম্পে ঢাকার যেসব এলাকা সবচেয়ে বেশি ও কম ঝুঁকিপূর্ণ | ছবি : সংগৃহীত
3

ভূমিকম্পের ঝুঁকির ক্ষেত্রে ঢাকাকে সাধারণত মাঝারি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা (Moderate Risk - Zone 2) হিসেবে শ্রেণীবদ্ধ করা হলেও, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, ঘনবসতি, এবং পুরোনো/ত্রুটিপূর্ণ ভবন কাঠামোর কারণে ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতির দিক থেকে ঢাকা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। বিশেষজ্ঞদের মতে, ঢাকার খুব কাছাকাছি সক্রিয় ফল্ট লাইন (Near Fault Lines) থাকায় দ্রুত ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করে সেগুলোর সংস্কার বা ভেঙে ফেলা এবং জনগণকে ভূমিকম্প প্রস্তুতি (Earthquake Preparedness) সম্পর্কে সচেতন করা এখনই সবচেয়ে জরুরি কাজ।

ভূতাত্ত্বিক অবস্থান এবং কাঠামোগত দুর্বলতা বিবেচনা করে বিশেষজ্ঞরা ঢাকার অভ্যন্তরে যে এলাকাগুলোকে সর্বাধিক ঝুঁকিপূর্ণ এবং তুলনামূলকভাবে কম ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, তা নিচে তুলে ধরা হলো:

আরও পড়ুন:

সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে থাকা ১৫টি এলাকা-Top 15 High-Risk Zones in Dhaka for Earthquake

গবেষণা অনুযায়ী, ঢাকার ভূমিকম্পে ভয়াবহ ক্ষতির ঝুঁকিতে (List of Dhaka's Earthquake Red Zones) থাকা ১৫টি এলাকা হলো:

  • সবুজবাগ (Sabujbagh),
  • কামরাঙ্গীরচর (Kamrangirchar),
  • হাজারীবাগ (Hazaribagh),
  • কাফরুল (Kafrul),
  • ইব্রাহিমপুর (Ibrahimpur),
  • কল্যাণপুর (Kalyanpur),
  • গাবতলী (Gabtoli),
  • উত্তরা (Uttra),
  • সূত্রাপুর (Sutrapur),
  • শ্যামপুর (Shyampur),
  • মানিকদী (Manikdi),
  • মোহাম্মদপুর (Mohammadpur),
  • পল্লবী (Pallabi),
  • খিলগাঁও (Khilgaon),
  • বাড্ডা (Badda)।

|এখন টিভি

ঝুঁকির প্রধান কারণ ও সীমাবদ্ধতাসমূহ

এই এলাকাগুলোকে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করার পেছনে মূলত কাঠামোগত দুর্বলতা এবং উদ্ধারকাজে সীমাবদ্ধতাকেই দায়ী করা হয়েছে:

  • ভবন নির্মাণে দুর্বলতা: বিল্ডিং কোড (Building Code) না মেনে ভবন নির্মাণ করা।
  • কাঠামোর অবস্থা: পুরোনো ও ভগ্নদশা ভবনসমূহের উপস্থিতি।
  • জনসংখ্যা ও ঘনত্ব: অত্যধিক জনসংখ্যা এবং ভবনগুলোর অতিরিক্ত ঘনত্ব।
  • যোগাযোগের সমস্যা: সংকীর্ণ রাস্তা ও প্রবেশপথের অভাব।
  • বিপজ্জনক স্থাপনা: দাহ্য গুদাম ও ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনার উপস্থিতি।
  • জরুরি ব্যবস্থার অভাব: খোলা জায়গার অভাব এবং অপ্রতুল চিকিৎসাসেবা।
  • উদ্ধার কাজে সীমাবদ্ধতা: ভূমিকম্প-পরবর্তী উদ্ধার ও সাড়াদান কার্যক্রমে সীমাবদ্ধতা।

আরও পড়ুন:

৩২টি এলাকার জরিপ: ঢাকার দক্ষিণাঞ্চলে ঝুঁকি বেশি-Dhaka's Most Earthquake Vulnerable Areas

রাজধানীর ভূমিকম্প ঝুঁকি (Seismic Risk) মূল্যায়নে মোট ৩২টি এলাকার ভৌত কাঠামো পর্যালোচনা করা হয়। এই জরিপে উত্তরা, গুলশান, ধানমন্ডি, তেজগাঁও, রমনা, শাহবাগ, আজিমপুর থেকে শুরু করে কামরাঙ্গীরচর, লালবাগ, সূত্রাপুর, শ্যামপুর, পল্লবী, কল্যাণপুর, মিরপুর, গাবতলী—ইত্যাদির মতো ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলগুলো অন্তর্ভুক্ত ছিল। জরিপের ফলাফলে দেখা যায়, কাঠামোগত দুর্বলতা এবং উদ্ধারকাজের সীমাবদ্ধতার কারণে ঢাকার দক্ষিণাঞ্চলের ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে বেশি। জরিপে দেখা গেছে, ঢাকা উত্তরাঞ্চলের কাফরুল, ইব্রাহিমপুর, কল্যাণপুর, মানিকদী ও গাবতলীসহ বেশ কিছু এলাকাও উচ্চ ঝুঁকির আওতায় রয়েছে।

একটি-অপরটির গা ঘেঁষে দাঁড়ানো ঢাকার দালানগুলোর ছবি |ছবি: এপি

ঢাকার যেসব এলাকা তুলনামূলক কম ঝুঁকিপূর্ণ-Dhaka's Least Earthquake Vulnerable Areas

বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ঢাকা শহরের অনেক এলাকার মাটি শত শত বছরের পুরোনো এবং মাটির গঠন দৃঢ় হওয়ায় এসব এলাকার ভূমিকম্প সহ্য করার ক্ষমতা তুলনামূলকভাবে বেশি (Relatively Safer Zones in Dhaka from Earthquake)। ভূতাত্ত্বিক স্থিতিশীলতা (Geological Stability) বিবেচনায় এসব এলাকায় বড় ভূমিকম্প হলেও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কম হতে পারে। কম ঝুঁকিতে (Low Seismic Risk Areas in Dhaka) থাকা পুরাতন মাটির এলাকাগুলো:

  • রমনা (Ramna),
  • পল্টন (Paltan),
  • মগবাজার (Moghbazar),
  • নিউমার্কেট (New Market),
  • লালমাটিয়া (Lalmatia),
  • কোতয়ালি (Kotwali),
  • সবুজবাগ (Sabujbagh),
  • খিলগাঁও (Khilgaon),
  • মতিঝিল (Motijheel),
  • ধানমন্ডি (Dhanmondi),
  • শের-ই-বাংলা নগর (Sher-e-Bangla Nagar),
  • মিরপুর (Mirpur),
  • ক্যান্টনমেন্ট (Cantonment),
  • পল্লবী (Pallabi),
  • শাহ-আলী (Shah Ali),
  • লালবাগ (Lalbagh),
  • গেন্ডারিয়া (Gendaria),
  • গুলশান (Gulshan),
  • তেজগাঁও (Tejgaon) এলাকাসহ বেশ কিছু পুরোনো মাটির অঞ্চল।

আরও পড়ুন:

রাজউকের চেয়ারম্যান ও ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত ভবন |ছবি: এখন টিভি

শুক্রবারের (২১ নভেম্বর) ভূমিকম্পের পর ছোট বড় ৩০০ ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার রিয়াজুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘শুক্রবারের ভূমিকম্পে ৩০০টির মতো ছোট বড় ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করতে পেরেছি। নিয়ম বহির্ভূত এবং নক্সা বহির্ভূত ভবন নির্মাণে রাজউক ও ভবনমালিক উভয়েরই দায় আছে। তবে, মূল দায়ী ভবনমালিক।’

রাজধানী ঢাকায় একটি বড় ভূমিকম্পের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরেছেন রাজউক (RAJUK)-এর নির্বাহী প্রকৌশলী খন্দকার মো. ওয়াহিদ সাদিক। বাংলাদেশ (আইইবি) ভবনে ‘ভূমিকম্পের ঝুঁকি হ্রাসে প্রস্তুতি ও করণীয়’ শীর্ষক সেমিনার ও মতবিনিময় সভায় তিনি মধুপুর ফাটলরেখায় ৬ দশমিক ৯ মাত্রার ভূমিকম্পের সম্ভাব্য ক্ষতির বিশ্লেষণ করেন। তার গবেষণা অনুযায়ী, এই মাত্রার একটি ভূমিকম্প আঘাত হানলে ঢাকার মোট ভবনের ৪০ শতাংশের কিছু বেশি অর্থাৎ ৮ লাখ ৬৪ হাজার ৬১৯টি ভবন সম্পূর্ণভাবে ধসে পড়তে পারে।

আরও পড়ুন:

মধুপুর ফল্টই ঢাকার প্রধান বিপদ: নতুন ভরাট অঞ্চলে বিপর্যয়ের আশঙ্কা

ঢাকা শহরে অভ্যন্তরীণভাবে ৮-৯ মাত্রার ভূমিকম্প ঘটানোর মতো কোনো বড় ফল্টলাইন না থাকলেও, নিকটবর্তী প্রধান ঝুঁকিটি নিয়ে গুরুতর সতর্কবার্তা দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রুবাইয়াত কবীর জানান, ঢাকা থেকে মাত্র ৬০ কিলোমিটার দূরে মধুপুর অঞ্চলে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প ঘটার জন্য যথেষ্ট সক্রিয় ফল্ট রয়েছে। তিনি সতর্ক করেন, এ ধরনের কম্পন যদি হয়, তবে ঢাকার নতুন ভরাট করা অঞ্চলগুলোতে বিরাট বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। তাঁর মতে, ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা এমন হতে পারে যে হতাহতের সংখ্যা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে এবং শহরের ভূপ্রকৃতিই বদলে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে।

প্রাকৃতিক দুর্যোগের চেয়ে মানুষের অব্যবস্থাপনাই সম্ভাব্য বিপর্যয়ের মূল কারণ হবে বলে মনে করেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)-র সাধারণ সম্পাদক শরিফ জামিল। তিনি বলেন, ঢাকার চারপাশের জলাভূমি রক্ষায় দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন চললেও বাস্তবে সেই এলাকাগুলোই সবচেয়ে বেশি দখল ও ভরাটের শিকার হয়েছে। তাঁর মতে, বড় ভূমিকম্প হলে সবচেয়ে ভয়াবহ ক্ষতি হবে ঠিক ওইসব এলাকায়—যেখানে প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে অপরিকল্পিতভাবে হাজার হাজার স্থাপনা দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাই, সম্ভাব্য বিপর্যয়ের জন্য প্রকৃতির চেয়ে মানুষের অব্যবস্থাপনাই বেশি দায়ী হবে।

ঢাকা শহরের ছবি |ছবি: এখন টিভি

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি)-এর সভাপতি অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান জানিয়েছেন, কোনো একটি এলাকায় ভূমিকম্পের ঝুঁকি কেমন হবে, তা চারটি মূল উপাদানের ওপর নির্ভর করে। এই উপাদানগুলোর সম্মিলিত প্রভাবেই ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা নির্ধারিত হয়:

  • মাটির গঠন (Soil Composition): এলাকাটির মাটি কেমন, অর্থাৎ ভূমিকম্পের কম্পন সহ্য করার ক্ষমতা মাটির কতটা রয়েছে।
  • আইন-কানুন মানা (Building Code Adherence): ভবন নির্মাণে যথাযথ বিল্ডিং কোড ও আইন-কানুন অনুসরণ করা হয়েছে কিনা।
  • ভবনের বয়স ও স্থায়িত্ব (Age and Stability): ভবনের নির্মাণকাল, বয়স এবং বর্তমান কাঠামোর মজবুতি।
  • অবকাঠামোর ঘনত্ব (Infrastructure Density): একটি নির্দিষ্ট এলাকায় ভবন ও অন্যান্য অবকাঠামোর ঠাসাঠাসি বা ঘনত্ব কেমন।

অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান সতর্ক করে বলেন, মাটির গঠন ভালো হলেও ভবন যদি নাজুক হয়, তবে সেই এলাকা ঝুঁকিপূর্ণই থাকবে। এর বিপরীতে, নির্মাণে নিয়ম-কানুন কঠোরভাবে মেনে চললে ওই এলাকায় ভূমিকম্পের সামগ্রিক ঝুঁকি অনেক কমে যায়।

আরও পড়ুন:

ভূমিকম্পের ঝুঁকি: বাংলাদেশের উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলসমূহ

বিশেষজ্ঞরা ভূমিকম্পের ঝুঁকির মাত্রা বিবেচনা করে বাংলাদেশকে প্রধানত তিনটি অঞ্চলে (Three Seismic Zones) ভাগ করেছেন। এর মধ্যে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের একটি বৃহৎ অংশকে 'উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল' (High Risk Zone) হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই অঞ্চলগুলোতে যেকোনো সময় বড় মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানার আশঙ্কা থাকে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ভূমিকম্পের উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে ঢাকা, কুমিল্লা, পার্বত্য চট্টগ্রাম, সিলেট, ময়মনসিংহ এবং রংপুর অঞ্চলের কিছু অংশ। একইভাবে, ময়মনসিংহ বিভাগের পাঁচটি জেলাও ভূমিকম্পের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

ঢাকা বিভাগের মধ্যে টাঙ্গাইল, গাজীপুর, নরসিংদী জেলার অংশ বিশেষ, পুরো কিশোরগঞ্জ জেলা এবং কুমিল্লা বিভাগের মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়া বড় মাত্রার ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে। এছাড়া খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি জেলার উত্তরাংশও ভূমিকম্পের উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে।

অন্যদিকে, ঢাকা, মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, কুমিল্লা, চাঁদপুর, ফেনী, নোয়াখালী, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, নওগাঁ, রাজশাহী, নাটোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জের অংশ বিশেষ এবং চট্টগ্রাম মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে। আর ভূমিকম্পের তুলনামূলক কম ঝুঁকিতে রয়েছে খুলনা ও বরিশাল বিভাগের জেলাগুলো।

আরও পড়ুন:

ভূমিকম্পের পূর্বাভাস পাওয়া কি সম্ভব?(Is Earthquake Prediction Possible?)

ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার জানান, কোথায় কোথায় ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে (Can Scientists Predict Earthquakes?), সেটি জানা সম্ভব কিন্তু এটি কোথায় ঘটবে, কখন ঘটবে এবং কত বড় আকারের হবে। এখন পর্যন্ত কেউই নিশ্চিতভাবে এটি বলতে পারে না।

ভূমিকম্প নিয়ে গুগলের সতর্কবার্তা কতটা নির্ভরযোগ্য? (Earthquake Forecasting Technology)

প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান গুগল দীর্ঘদিন ধরেই এক যুগান্তকারী প্রযুক্তি তৈরির চেষ্টা করছে, যেটি ভূমিকম্প আঘাত হানার কয়েক সেকেন্ড আগেই ব্যবহারকারীদের সতর্কবার্তা দিতে সক্ষম। এই লক্ষ্য পূরণে গুগল যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ বিভাগ (USGS) এবং ক্যালিফোর্নিয়ার বেশকিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করছে।

বিশেষজ্ঞরা বিশ্বাস করেন, এই সতর্কবার্তা ভূমিকম্পের কয়েক সেকেন্ড আগে পৌঁছানো সম্ভব। আর এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কয়েক সেকেন্ডই কাউকে দ্রুত কোনো টেবিল বা খাটের নিচে আশ্রয় নেওয়ার সময় দেবে, অথবা ট্রেনের গতি কমিয়ে দুর্ঘটনা এড়ানোর সুযোগ করে দেবে। গুগল মনে করছে, বড় ধরনের ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে সময়মতো পাওয়া এই সতর্কবার্তা অনেকের জীবন বাঁচাতে সক্ষম হবে। এই প্রযুক্তি ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে একটি বড় সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে।

আরও পড়ুন:

ভূমিকম্পের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নোত্তর-FAQ

প্রশ্ন: বাংলাদেশ কি ভূমিকম্পের উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে অবস্থিত?

উত্তর: হ্যাঁ। বাংলাদেশকে বিশেষজ্ঞরা তিনটি ভূমিকম্প জোনে ভাগ করেছেন এবং দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল (সিলেট-ময়মনসিংহ) ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল (পার্বত্য চট্টগ্রাম) উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ (High Risk Zone) হিসেবে চিহ্নিত।

প্রশ্ন: ঢাকা শহর কী উচ্চ ঝুঁকিতে আছে?

উত্তর: ভূতাত্ত্বিকভাবে ঢাকা মাঝারি ঝুঁকিপূর্ণ জোনে (Zone 2) থাকলেও, দুর্বল ভবন কাঠামো, অপরিকল্পিত নির্মাণ ও অত্যধিক ঘনবসতির কারণে এটি ক্ষয়ক্ষতির দিক থেকে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।

প্রশ্ন: ঢাকার সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ ১৫টি এলাকা কী কী?

উত্তর: গবেষণায় চিহ্নিত ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোর মধ্যে রয়েছে—কামরাঙ্গীরচর, হাজারীবাগ, সূত্রাপুর, সবুজবাগ, কাফরুল, মোহাম্মদপুর, পল্লবী, খিলগাঁও ইত্যাদি।

প্রশ্ন: ঢাকার কোন ফল্টলাইনটি সবচেয়ে বিপজ্জনক?

উত্তর: ঢাকার খুব কাছে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত মধুপুর ফল্ট (Madhupur Fault) সবচেয়ে বিপজ্জনক, যা ৭ মাত্রার ভূমিকম্প ঘটাতে সক্ষম।

প্রশ্ন: মধুপুর ফল্টে বড় ভূমিকম্প হলে ঢাকার কী ক্ষতি হতে পারে?

উত্তর: বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ৬.৯ মাত্রার ভূমিকম্প হলে ঢাকার মোট ভবনের ৪০ শতাংশের বেশি (প্রায় ৮ লাখ ৬৪ হাজার ভবন) ধসে পড়তে পারে এবং এতে ৩ লাখ কোটি টাকার বেশি আর্থিক ক্ষতি হতে পারে।

প্রশ্ন: ঢাকার কোন এলাকাগুলো তুলনামূলকভাবে কম ঝুঁকিপূর্ণ?

উত্তর: পুরোনো এবং দৃঢ় মাটির ওপর অবস্থিত এলাকা, যেমন—রমনা, মতিঝিল, গুলশান, নিউমার্কেট, ধানমন্ডি (কিছু অংশ) মাটির গঠনের কারণে তুলনামূলকভাবে কম ঝুঁকিতে থাকে।

প্রশ্ন: মাটির গঠন ভালো হলেও ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে কেন?

উত্তর: বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) অনুযায়ী, মাটির গঠন ভালো হলেও ভবন নির্মাণে বিল্ডিং কোড (Building Code) না মানা হলে সেই এলাকা ঝুঁকিপূর্ণই থেকে যায়।

প্রশ্ন: ভরাট করা জলাভূমি ভূমিকম্পে কেন বেশি বিপজ্জনক?

উত্তর: জলাভূমি ভরাট করে তৈরি করা নতুন মাটি নরম ও অস্থির থাকে। ভূমিকম্পের সময় এই মাটি ঝাঁকুনিকে কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয় (Amplification), যা ভবন ধসের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে।

প্রশ্ন: পুরোনো ঢাকা কেন এত ঝুঁকিপূর্ণ?

উত্তর: পুরোনো ঢাকায় ভবনগুলো শত বছরের পুরোনো, ভগ্নদশা, এবং অত্যন্ত ঘন সন্নিবদ্ধ (হাই ডেনসিটি)। এছাড়া সরু রাস্তার কারণে উদ্ধারকাজ অসম্ভব হয়ে উঠবে।

প্রশ্ন: কোন কোন বিভাগের জেলাগুলো বড় মাত্রার ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে আছে?

উত্তর: সিলেট, ময়মনসিংহ, এবং কুমিল্লা (ব্রাহ্মণবাড়িয়া)-এর মতো বিভাগগুলোর অনেক জেলা উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে।

প্রশ্ন: ভূমিকম্পে ঝুঁকি কমাতে ব্যক্তিগতভাবে কী করা উচিত?

উত্তর: জরুরি অবস্থায় ব্যবহারের জন্য ক্লিয়ার স্পেস (Clear Space) চিহ্নিত করা, জরুরি কিট (Emergency Kit) প্রস্তুত রাখা এবং ভবনের স্থায়িত্ব পরীক্ষা করা উচিত।

প্রশ্ন: ভবন নির্মাণে বিল্ডিং কোড মানা হয়েছে কিনা, তা কীভাবে জানব?

উত্তর: আপনার ভবনের নকশা ও অনুমোদন সংক্রান্ত তথ্য রাজউক (RAJUK) বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে যাচাই করা যেতে পারে।

প্রশ্ন: ভূমিকম্পের সময় কেন উদ্ধারকাজ কঠিন হবে?

উত্তর: ঢাকার অনেক এলাকায় রাস্তা সংকীর্ণ, খোলা জায়গার অভাব এবং দাহ্য গুদাম থাকায় ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে উদ্ধারকাজ পরিচালনায় মারাত্মক সীমাবদ্ধতা তৈরি হবে।

প্রশ্ন: টাঙ্গাইল, গাজীপুর এবং কিশোরগঞ্জ কি ঢাকার ফল্টলাইনের কারণে ঝুঁকিতে?

উত্তর: হ্যাঁ, ঢাকা বিভাগের এই জেলাগুলো মধুপুর ফল্টের কাছাকাছি থাকায় এবং ভূ-প্রকৃতির কারণে উচ্চ মাত্রার কম্পনের ঝুঁকিতে রয়েছে।

প্রশ্ন: ভূমিকম্পের পূর্বাভাস পাওয়া কি সম্ভব?

উত্তর: এখন পর্যন্ত ভূমিকম্পের পূর্বাভাস (Prediction) দেওয়ার নির্ভরযোগ্য কোনো প্রযুক্তি নেই। তবে গুগলের মতো সংস্থাগুলো আর্লি ওয়ার্নিং সিস্টেম (Early Warning System) তৈরি করছে যা কয়েক সেকেন্ড আগে সতর্কবার্তা দিতে পারে।

প্রশ্ন: ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলো ভূমিকম্পের সময় কেন বেশি বিপজ্জনক?

উত্তর: ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় ভবন ধস হলে হতাহতের সংখ্যা কয়েকগুণ বেড়ে যায় এবং সরু রাস্তার কারণে জরুরি পরিষেবা পৌঁছানো সম্ভব হয় না।

প্রশ্ন: কোন ধরনের ভবনগুলো ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি দুর্বল?

উত্তর: বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেসব ভবন নির্মাণে গুণগত মান (Quality) বজায় রাখা হয়নি, এবং যেসব ভবন ৪ থেকে ৩০ তলার মধ্যে অপরিকল্পিতভাবে নির্মিত, সেগুলো বেশি দুর্বল।

প্রশ্ন: ভূমিকম্পের ঝুঁকি কমাতে সরকার কী পদক্ষেপ নিচ্ছে?

উত্তর: সরকার ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিতকরণ, ভবন নির্মাণে নতুন কোড কার্যকর করা এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সক্ষমতা বৃদ্ধির চেষ্টা করছে।

ভূমিকম্পের পর করণীয় কী?

উত্তর: কম্পন থেমে গেলে দ্রুত খোলা জায়গায় যাওয়া, ক্ষতিগ্রস্ত ভবন থেকে দূরে থাকা এবং জরুরি পরিষেবার জন্য অপেক্ষা করা।

ঢাকা শহরের ভূপ্রকৃতি বদলে যাওয়ার পরিস্থিতি বলতে কী বোঝানো হয়েছে?

উত্তর: এর অর্থ হলো, ব্যাপক মাত্রার ভূমিকম্পের ফলে মাটির নিচে লিকুইফেকশন (Liquefaction) হতে পারে, যার ফলে অনেক এলাকা স্থায়ীভাবে দেবে যেতে পারে বা বড় ধরনের ভৌগোলিক পরিবর্তন আসতে পারে।


এসআর