আজ (সোমবার, ১৭ নভেম্বর) দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে কার্যক্রম শুরু হয়। ৪৫৩ পৃষ্ঠার এ রায়ে ছয়টি অংশ রয়েছে। রায়ে ট্রাইব্যুনাল বলেছেন, শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির অপরাধ প্রমাণিত।
তবে চব্বিশের জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থান দমনে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে করা মামলার তদন্ত থেকে শুরু করে বিচার— সব পর্যায়ের বৃত্তান্ত এগিয়েছে আইনি পদ্ধতি অনুসরণ করে।
মামটির নম্বর আইসিটি বিডি কেস নম্বর ২/২০২৫। চিফ প্রসিকিউটর বনাম শেখ হাসিনা ও অন্যান্য শিরোনামে দায়ের হওয়া এ মামলায় আসামি করা হয়েছিল ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে।
অভিযোগ প্রাপ্তি ও তদন্ত শুরু
২০২৪ সালের ১৪ আগস্ট এবং ২৯ অক্টোবর অভিযোগ পাওয়ার পর তদন্ত শুরু হয়। মিস কেস নং ০২/২০২৪ করা হয় ১৬ অক্টোবর। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয় ১৬ অক্টোবর এবং অন্যদের বিরুদ্ধে ১৭ অক্টোবর। গ্রেপ্তার আসামি সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে গত ১৬ মার্চ গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
আরও পড়ুন:
তদন্ত প্রতিবেদন ও চার্জ
তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয় ১২ মে। ১ জুন দাখিল হয় ফরমাল চার্জ বা আনুষ্ঠানিক অভিযোগ। এতে ১৪ খণ্ডে প্রায় ১০ হাজার পৃষ্ঠার দালিলিক সাক্ষ্য জমা দেয়া হয়। এর মধ্যে ছিল পত্রপত্রিকা, দেশি-বিদেশি অনুসন্ধান প্রতিবেদন, শহিদ ও আহতদের তালিকাসহ গেজেট, বই, স্মারকগ্রন্থ, ঘটনাভিত্তিক তালিকা, গ্রাফিতির বই, অভ্যুত্থানকালীন প্রকাশিত পত্রিকার প্রথম পাতার সংকলন, আহতদের চিকিৎসা সনদ, পোস্টমর্টেম ও সুরতহাল প্রতিবেদন, অস্ত্র ও বুলেট ব্যবহারের জিডি, হেলিকপ্টারের ফ্লাইট শিডিউলসহ নানান নথি। ৯৩টি প্রদর্শনীর মাধ্যমে এসব দালিলিক সাক্ষ্য ও ৩২টি বস্তু প্রদর্শনীর মাধ্যমে বুলেট, পিলেট, রক্তমাখা কাপড়, ভিডিও, অডিও, ডিভিডি, পেনড্রাইভ ও বই ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করা হয়।
মোট ৮৪ জন সাক্ষীর জবানবন্দি জমা পড়ে, যার মধ্যে ৫৪ জন সরাসরি সাক্ষ্য দেন। ১৭ জুন পলাতক আসামিদের জন্য দুই জাতীয় পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। ২৪ জুন রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী নিয়োগ দেয়া হয়। ১ জুলাই চার্জ শুনানি শুরু হয় এবং ১০ জুলাই অভিযোগ গঠন করা হয়। এসময় সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন দোষ স্বীকার করেন।
প্রসিকিউশনের ওপেনিং স্টেটমেন্ট উপস্থাপন করা হয় ৩ আগস্ট। একই দিন সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। প্রথম সাক্ষী ছিলেন গুরুতর আহত খোকন চন্দ্র বর্মন। ৮ অক্টোবর শেষ সাক্ষ্য দেন তদন্ত কর্মকর্তা মো. আলমগীর। মোট ৫৪ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষে ১২ অক্টোবর শুরু হয় যুক্তিতর্ক। ২৩ অক্টোবর এটর্নি জেনারেলের সমাপনী বক্তব্যের মধ্য দিয়ে তা শেষ হয় এবং রায়ের তারিখ ঘোষণার জন্য অপেক্ষায় রাখা হয়।
আরও পড়ুন:
গত ১৩ নভেম্বর ট্রাইব্যুনাল আজ ১৭ নভেম্বরকে রায় ঘোষণার দিন ধার্য করে।
প্রসিকিউশনের অভিযোগগুলো
প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়েছে।
অভিযোগ ১:
চব্বিশের ১৪ জুলাই গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকারের বাচ্চা রাজাকারের নাতিপুতি’ সম্বোধন করে উস্কানিমূলক বক্তব্য দেন। এরপর ওবায়দুল কাদেরসহ কয়েকজন নেতা একই ধরনের মন্তব্য করেন। এসব বক্তব্যের পর ছাত্ররা আন্দোলনে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের সশস্ত্র ক্যাডাররা আন্দোলনকারীদের ওপর আক্রমণ করে ও নির্যাতন চালায়।
সাক্ষ্যপ্রমাণ:
বিটিভি থেকে প্রাপ্ত ওই সংবাদ সম্মেলনের ভিডিও, শেখ হাসিনার বক্তব্য সমর্থন করে ওবায়দুল কাদেরসহ অন্যান্য নেতার বক্তব্যের ভিডিও ও সংবাদ, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের ওপর আওয়ামী লীগের হামলার অনুসন্ধানী প্রতিবেদন, দেশব্যাপী হত্যা ও নির্যাতনের খবর ও ভিডিও এবং প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগীদের সাক্ষ্য।
অভিযোগ ২:
কাউন্ট-১, ১৪ জুলাই রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি মাকসুদ কামালকে ফোন দিয়ে আসামি শেখ হাসিনা আন্দোলনকারীদের রাজাকার ট্যাগ দিয়ে তাদের ফাঁসি অর্থাৎ হত্যার নির্দেশ দেন।
আরও পড়ুন:
কাউন্ট-২, ১৮ জুলাই শেখ ফজলে নূর তাপসের সঙ্গে কথোপকথনে লেথাল উইপন (মরণাস্ত্র) ব্যবহারের নির্দেশ, ড্রোন ব্যবহার করে অবস্থান শনাক্ত করা এবং হেলিকপ্টার থেকে গুলি করার নির্দেশসহ সরকারি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা পুড়িয়ে জনতার উপর দায় চাপানোর নির্দেশনা প্রদান করেন।
কাউন্ট-৩, হাসানুল হক ইনুর সঙ্গে ফোনে দুই বার কথোপকথনে আন্দোলনকারীদের ওপর হেলিকপ্টার থেকে বোমা নিক্ষেপ, আটক-নির্যাতন এবং বিএনপি, জামায়াত ও জঙ্গি ট্যাগ দেয়ার নির্দেশ দেন।
সাক্ষ্যপ্রমাণ:
সরকারি প্রতিষ্ঠান এন টি এম সি থেকে পাওয়া ভয়েস রেকর্ড ও সেগুলোর ফরেনসিক রিপোর্ট এবং ট্রান্সক্রিপশন, শহিদদের তালিকা, আহতদের তালিকা সম্বলিত গেজেট, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী কর্তৃক প্রকাশিত ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতায় শহিদ যারা’ নামক দশ খণ্ডের শহিদদের তালিকা। গুলিবিদ্ধদের শরীর থেকে প্রাপ্ত বুলেট ও পিলেট, গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী মোবাইলে ধারণকৃত ভিডিও ফুটেজ ও ছবি, পত্রপত্রিকা, ১৪০০ শহিদ হওয়ার ঘটনা কথা উল্লেখ করা জাতিসংঘ কমিশনের প্রতিবেদন, বিবিসি ও আল জাজিরার প্রতিবেদন, হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদন, ইন্টারন্যাশনাল ট্রুথ অ্যান্ড জাস্টিস প্রোজেক্টের (আইটিজেপি) ডকুমেন্টারি; ভুক্তভোগী, তাদের পরিবার, চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞদের সাক্ষ্য, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলি ব্যবহারের হিসাব, হেলিকপ্টারের ফ্লাইট শিডিউল, কার্ফিউ জারির সরকারি আদেশ ও ‘দেখামাত্র গুলি’র নির্দেশ।
অভিযোগ ৩:
১৬ জুলাই রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনের সমন্বয়ক আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যার অভিযোগ।
আরও পড়ুন:
সাক্ষ্যপ্রমাণ:
শেখ হাসিনার ১৪ জুলাইয়ের সংবাদ সম্মেলনের ভিডিও, ঢাবি ভিসি মাকসুদ কামালের সঙ্গে কথোপকথনের রেকর্ড, আবু সাঈদকে পুলিশের গুলির সময় এনটিভির লাইভ ভিডিও ও মূল কপি, আবু সাইদের পাঁচটি পোস্টমর্টেম রিপোর্ট যা পুলিশের নির্দেশে চারবার পরিবর্তন করা হয়, ওই ঘটনায় সাজানো মামলার নথি, আবু সাঈদের পরিবারের সদস্য, সাংবাদিক, ডাক্তার, ছাত্র ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য।
অভিযোগ ৪:
চব্বিশের ৫ আগস্ট ঢাকার চানখারপুল এলাকায় ছয়জনকে গুলি করে হত্যার অভিযোগ।
সাক্ষ্যপ্রমাণ:
পুলিশের নির্বিচারে গুলির ভিডিও ও আরটিভি থেকে পাওয়া মূল কপি, শহিদ আনাসকে গুলি করার ভিডিও, তার মাকে লেখা চিঠি এবং তাকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় রিকশায় করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ভিডিও, ইয়াকুবকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ধরাধরি করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য রিক্সায় তুলে দেয়ার ভিডিও, আন্দোলনকারী ও আশেপাশের বিল্ডিং থেকে ব্যক্তিগত মোবাইলে ধারণকৃত ভিডিও, বিটিভির জুলাই অনির্বাণ ডকুমেন্টারি, শহিদ পরিবার, নির্দেশ অমান্য করা পুলিশ সদস্য ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য।
আরও পড়ুন:
অভিযোগ ৫:
চব্বিশের ৫ আগস্ট আশুলিয়া থানা এলাকায় ছয়জনকে হত্যা করে তাদের মরদেহ আগুনে পুড়িয়ে দেয়ার অভিযোগ।
সাক্ষ্যপ্রমাণ:
আশুলিয়া থানার পুলিশ কর্তৃক গুলির ভিডিও, নিহতদের ছয়টি মরদেহ ভ্যানে তোলার ও চাদর দিয়ে ঢেকে দেয়ার ভিডিও, পোড়া মরদেহের ছবি, পরিবারের সদস্য ও পুলিশ সদস্যদের সাক্ষ্য।
সাক্ষীদের পরিচয়
ভুক্তভোগী, আহত, শহিদ পরিবার, প্রত্যক্ষদর্শী, চিকিৎসক, সাংবাদিক, দোষ স্বীকারকারী আসামি, ফরেনসিক ও ব্যালিস্টিক বিশেষজ্ঞ, আন্দোলনকারী, পুলিশ, ওয়ারলেস অপারেটর, তদন্ত সংস্থার লাইব্রেরিয়ান ও তদন্ত কর্মকর্তা।





