দুর্গম পাহাড় আর গভীর অরণ্যে ঘেরা বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত। এ শান্ত-স্নিগ্ধ প্রকৃতির আড়ালে লুকিয়ে আছে এক ভয়াবহ বাস্তবতা। মায়াবী এ সৌন্দর্যের প্রতি পদে পদে ওঁত পেতে আছে মৃত্যুঝুঁকি। সীমান্তের ওপারে, নোম্যান্স ল্যান্ডে, অসংখ্য স্থলমাইন পুঁতেছে মিয়ানমার।
তবুও এ সীমান্তজুড়ে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে গরু-মহিষ, মাদক পাচার ও নিত্যপণ্য পাচারকারী চক্রের ভয়ঙ্কর অপরাধ আর তৈরি হচ্ছে অর্থের লোভে কিছু নিরীহ মানুষের বলি হওয়ার নির্মম গল্প।
সীমান্তের ওপার থেকে চোরাইপথে গরু, মাদক কিংবা কাঠ পাচার করে আনা এবং বাংলাদেশ থেকে নিত্যপণ্য পাচারের ঝুঁকি নিতে গিয়ে অজান্তে অনেকেই পা রাখছেন মিয়ানমারের পুঁতে রাখা স্থলমাইনে। আর এক মুহূর্তেই ছিন্নভিন্ন হচ্ছে তাদের জীবন, পরিবারের ওপর নেমে আসছে অন্ধকার।
কক্সবাজারের রামু উপজেলার গর্জনিয়ার বাসিন্দা মো. আব্দুল্লাহ। এক বছর আগে সীমান্তের ওপারে গরু আনতে গিয়ে স্থলমাইনে হারিয়েছেন দুই পা। প্রায় একই গল্প নাইক্ষ্যংছড়ির জারুলিয়াছড়ি সীমান্তের বাসিন্দা নুরুল আবছারের। চোরাইপথে মহিষ আনতে গিয়ে তিনিও হারিয়েছেন এক পা। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সামান্য আয়ের জন্য চোরাচালানে জড়ানো এ মানুষগুলো মাইন বিস্ফোরণে হারাচ্ছেন তাদের জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ। কিন্তু কিভাবে, কেন তারা শামিল হন এ ধরনের অপরাধে?
আরও পড়ুন:
কাঠ আনতে গিয়ে পা হারানো ভুক্তভোগী নুরুল আবছার বলেন, ‘আমরা আমাদের প্রয়োজন মেটানোর জন্য কাঠ কেটে নিয়ে আসতাম। সীমান্তের পাশে আমাদের সঙ্গে এ দুর্ঘটনা ঘটে যেখানে আমি আমার পা হারিয়ে ফেলি।’
স্থলমাইন বিস্ফোরণের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় সীমান্তজুড়ে এমন সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিয়েছে বিজিবি। বাড়ানো হয়েছে নজরদারি। সীমান্তে সাধারণ লোকজনকে যাতায়াতে নিরুৎসাহিত করতে মাইকিং ও ড্রোন নজরদারির পাশাপাশি বাড়ানো হয়েছে বিজিবি টহল। যদিও শুধু চলতি বছরেই সীমান্তে স্থলমাইন বিস্ফোরণে অন্তত দশজন আহত হয়ে পা হারিয়েছেন। তবে গত এক মাসে কোনো মাইন বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেনি।
নাইক্ষ্যংছড়ি ১১ বিজিবি সহকারী পরিচালক মো. আল আমিন বলেন, ‘এখন এমন ঘটনা অনেক কমে এসেছে। আপনারা যদি পরিসংখ্যানটি দেখেন বিগত একমাসে কোনো মাইন বিস্ফরণের ঘটনা ঘটেনি। আমরা এ কার্যক্রম অব্যাহত রাখবো।’
বিজিবি ও স্থানীয় প্রশাসনের প্রচেষ্টায় সচেতনতা বেড়েছে, তবে চোরাচালানের প্রলোভনে এখনও অনেকে সীমান্তে পা রাখছেন। স্থানীয়দের সচেতনতার অভাব এবং শিক্ষার নিম্নহারও ঝুঁকি বাড়িয়েছে বলে মনে করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা।
বান্দরবান নাইক্ষ্যংছড়ি ইউএনও মাজহারুল ইসলাম বলেন, ‘প্রাথমিক থেকে শুরু করে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক যারা আছেন আমরা তাদের বলবো আপনারা শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা ভেবে একটি জেনারেশন গড়ে তুলুন। জনসচেতন ছাড়া এটিকে মোকাবেলা করা সম্ভব হবে না।’
বিজিবি বলছে, ব্যক্তিগত লোভের কারণেই অনেকে এ ঝুঁকিপূর্ণ পথে পা বাড়াচ্ছেন। এমন পরিস্থিতিতে চোরাচালান চক্রের মূল হোতাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে, যা এ সমস্যার সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ।
নাইক্ষ্যংছড়ি অধিনায়ক-১১ বিজিবি কর্নেল লে. এস একে এম কপিল উদ্দিন বলেন, ‘বাংলাদেশ মিয়ানমার সীমান্তে কোনো ডিফেন্সিং নেই। ফলে চোরাচালানকারীদের যাতায়াত ছিল এ পথে। গত তিন থেকে চার বছরে এ ঘটনাটি বৃদ্ধি পেয়েছিল। এ বছর জানুয়ারি থেকে আমরা বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছি।’





