বহির্বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন এক দেশ দক্ষিণ এশিয়ার মিয়ানমার। গত কয়েক বছর ধরে গৃহযুদ্ধের জর্জরিত হয়ে আছে মিয়ানমার। জান্তা সরকারের সঙ্গে সশস্ত্র যুদ্ধে জড়িয়েছে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো। দিন দিন বেড়েই চলেছে যুদ্ধের ব্যাপ্তি। সামনে আসছে মিয়ানমার ইস্যুতে পরাশক্তিগুলোর দ্বন্দ্ব। এমন পরিস্থিতিতে খবরের শিরোনাম হয়েছে জান্তা সরকারের হাতে বন্দি মিয়ানমারের সাবেক গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী অং সান সুচির বাড়ি।
ইয়াঙ্গুনের ইনিয়ে লেকের পাশে প্রায় দুই একর জায়গার ওপর মনোরম বাড়িটি তৃতীয়বারের মতো বিক্রির চেষ্টা মুখ থুবড়ে পড়ে। হেরিটেজ হাউজের মতো এই বাড়িটি কিনতে কেউ আসেননি, তাই নিলামের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা চলে গেলেন খালি হাতে। ২০২৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ন্যূনতম দাম ১৪ কোটি ডলার ধরে বাড়িটি বিক্রির জন্য নিলাম শুরু করে জান্তা সরকার।
১৯৪৭ সালে সুচির বাবা মিয়ানমারের স্বাধীনতার নেতা জেনারেল অং সান নিহত হওয়ার পর তার মা খিন কি ছেলেমেয়ের নামে বাড়িটি দিয়ে দেন। মিয়ানমারের ইতিহাসে বাড়িটি একটি বিশেষ জায়গা দখল করে আছে। ১৯৮৮ সালে তৎকালীন জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভের সময় জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন অং সান সু চি। এরপর তাকে বাড়িটির জীর্ণ চার দেয়ালের মধ্যে টানা ১৫ বছর গৃহবন্দী করে রাখা হয়েছিল। সে সময় সু চির স্বামী ও সন্তানরা ইংল্যান্ডে ছিলেন। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন সু চি বন্দিদশায় পিয়ানো বাজিয়ে, গোয়েন্দা উপন্যাস পড়ে ও ধ্যান করে সময় কাটাতেন।

মিয়ানমারের সাবেক গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী অং সান সুচির বাড়ি। ছবি: সংগ্রহীত
২০০০ সালে এই বাড়িটি নিয়ে বিরোধ সুচির ভাই অং সান উ- এর সাথে। তিনি বর্তমানে ক্যালিফোর্নিয়ায় অবস্থিত মার্কিন নাগরিক। সুচি নিজের ক্ষমতাবলে পুরো বাড়ি দখল করে রেখেছেন বলে অভিযোগ তার। তাই বাড়িটির অংশ পাওয়ার জন্য আদালতে মামলা করেন। আদালত ২০১৬ সালে সম্পত্তিটি দুই ভাই-বোনের নামে সমানভাবে ভাগ করার রায় দেন। অং সান উ এই বাড়ি বিক্রি করে অর্থ ভাগাভাগি করার জন্য এরপর বেশ কয়েকবার আদালতে যান। কিন্তু একজন বিদেশি নাগরিক হিসাবে অং সান উ আইনত এটির মালিকানা বা বিক্রির অনুমতি পাননি।
২০১০ সালে মুক্তি পাওয়ার পর সু চি ওই বাড়িতেই থাকতেন। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, সাংবাদিক, কূটনীতিকসহ বিভিন্ন বিদেশি নেতার সঙ্গে সেখানেই তিনি সাক্ষাৎ করেছেন।
অবশেষে ২০২১ সালে মিলিটারি সুচিকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে আটক করার পর আদালত অং সান উ'য়ের বিশেষ আপিলের প্রেক্ষিতে নিলামের অনুমতি দেয়। জান্তা সরকারের প্রতি পূর্ণ সমর্থন করে অং সান উ আবেদন করেন, নিলাম থেকে প্রাপ্ত অর্থ যেন দুই ভাই বোনের মাঝে সমানভাবে ভাগ করে দেয়া হয়।
তবে রিয়েল এস্টেট এজেন্টরা বলছেন, অভিজাত ইয়াঙ্গুন অঞ্চলে এই আকারের সম্পত্তির দাম ১০ থেকে ২০ লাখ ডলার হতে পারে। সামরিক অভ্যুত্থানে সৃষ্ট গৃহযুদ্ধের ফলে মিয়ানমারের অর্থনীতি ভেঙে পড়ার পর ক্রমেই জীর্ণ হয়ে পড়া বাড়িটির জন্য কেউ ১৪ কোটি ডলার ব্যয় করতে রাজি নয়। তবে মিয়ানমারের ভঙ্গুর অর্থনৈতিক অবস্থা জেনেও জান্তা সরকার কেন বাড়িটির দাম এত বেশি হাঁকাচ্ছে, তাও স্পষ্ট নয়।
তবে মিয়ানমারের আইন প্রণয়নকারী সংসদ সদস্যদের সংস্থা ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট সতর্ক করেছে, ঐতিহাসিক এই সম্পত্তি বিক্রয়, ক্রয় বা ধ্বংস করা বেআইনি এবং এর পরিণতি হবে গুরুতর। তারা মনে করে, পরিবারিক বিরোধ এবং রাজনৈতিক প্রতিহিংসার বলি হয়েছে গণতন্ত্রের প্রতীক হিসেবে খ্যাত এই বাড়ি।
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মিয়ানমারের ক্ষমতা পুনর্দখলের পর সামরিক বাহিনী সুচিকে গ্রেপ্তার করেছিল। নোবেল জয়ী সুচি এখন রাষ্ট্রদ্রোহ, ঘুষ কেলেঙ্কারি, আইন লঙ্ঘনসহ বিভিন্ন অপরাধে ২৭ বছরের জেল খাটছেন। তাকে কোথায় রাখা হয়েছে তা জান্তা সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়নি।