কত রক্ত সাগর পেরিয়ে এ মাটির সন্তানেরা স্বাধীনতার সূর্য ছিনিয়ে এনেছিলেন ঠিকই কিন্তু শোষণের পাষাণ শিকল ছিঁড়েনি। ঐ শেকল ভাঙার গানে সুর মেলাতে গিয়ে ২০২৪ সালে গণঅভ্যুত্থানের দুই হাজার শহীদের মতোই এই বাংলার মাটিতে আবার মিলেছে শহীদ সায়েম, যাকে বলা হচ্ছে এ দেশের দ্বিতীয় স্বাধীনতা।
পাঁচ দশক পর, একটা স্বাধীন দেশ, সে দেশের সরকার, যার দায়িত্ব মানুষের অধিকার নিশ্চিত করা, তাদের নির্দেশে কী করে, যার নিরপরাধ ছেলেকে টার্গেট করে হত্যা করা হলো, তা বুঝে উঠে পারেন না, রাজনীতির মারপ্যাঁচ না বোঝা মা। এবং শহরতলীর রসূলগাঁও মাদ্রাসা কবরস্থান তার এই আর্তনাদ, আহাজারির সাক্ষী হচ্ছেন অনেকবারই, ১৯ জুলাই ২০২৪ এর পর।
শহীদ সায়েমের মা বলেন, 'আমাদের ছেলেরা যে রক্ত দিলো, তাদের বিনিময়ে যেন একটা ভালো সুষ্ঠু বাংলাদেশ পাই, দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ পাই। আমাদের চাওয়া একটাই যে সঠিক বাংলাদেশ যেন আমরা পাই। আর আমাদের ছেলেদের যারা নির্মমভাবে, অন্যায়ভাবে হত্যা করেছে তাদের বিচার চাই।'
১৮ জুলাই, পুলিশের গুলিতে পিঠ ঝাঁজরা হওয়ার আগের দিনেও, ১৭ বছরের রোমান ঢালী দাপিয়ে বেড়িয়েছেন চালাবনের ফুটবল মাঠে। পাঁচ মাস হলো রোমান দুই পায়েই আর কোনো অনুভূতি পান না। জীবনে আর কখনও পাবেন কি না, সেটি অনেক শঙ্কার, কারণ তার শরীরে আটটি স্প্রিন্টারের সঙ্গে শিরদাড়ায় বিঁধে আছে ঘাতকের বুলেট। এখন টেলিভিশনের প্রতিনিধি দল জানতে চেয়েছিল আসলে কী চেয়েছিল সে?
মো. রাতুল ঢালী বলেন, 'আমরা একটা স্বৈরাচার দূর করতে পেরেছি, এটাই বড় কথা। দেশের মানুষ যেন বুক ফুলিয়ে হাঁটতে পারে। সবার জন্য সমান বাংলাদেশ চাই। কেউ যে এমপির ছেলে দেখে বেশি সুযোগ পাবে এটা যেন না হয়। সবাই সমান এখানে। আমরা এজন্যই আন্দোলনটা করছি। আমরা কোনো দল ধরে আন্দোলন করিনি। আমরা চাই না আওয়ামী লীগের মতো আরও একটা দল এসে এমন করুক। এরকম হলে আবার আমরা নামবো। এবার জান দেইনি, পরবর্তীতে আমরা জান দিবো।'
পাঁচ দশক আগে, এখানে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু পাঁচ দশকেও পূরণ হয় নি, সাম্য, মানবিক মর্যাদা কিংবা সুশাসন প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন। কিন্তু এখন ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে এই যে নতুন এক বাংলাদেশ, তখন আবার প্রশ্ন উঠেছে উল্টো পথে কি হাঁটছে বাংলাদেশ?
৭৩ বছর বয়সী মুক্তিযোদ্ধা ড. মো. শফিকুল ইসলাম, যিনি একই চোখে ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ এবং ২৪ এর আন্দোলন দেখেছেন। তিনি বলছেন, প্রচলিত রাজনৈতিক সংস্কৃতি, দুর্নীতি অনিয়মের বাইরে গিয়ে বাংলাদেশ পুনর্গঠনের যে আরেকটা সুযোগ এসেছে, তা কতটা সফল হবে তার জন্য আরও অপেক্ষা করতে হবে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা ড. মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, 'আমাদের সন্তানরা ৭১ এ রণাঙ্গনে কিন্তু এই ধরনের মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তানরাই যুদ্ধ করেছে। আওয়ামী লীগের কোনোরকম অবদান নেই। আজ তারা এককভাবে সোল এজেন্ট হিসেবে মনে করে। কারণ শেখ মুজিব নিজেও এ দেশের স্বাধীনতা চান নাই। আওয়ামী লীগ কিন্তু কথাগুলো বলছে না। এখন আর সে অবস্থা নেই বলে আমি আশাবাদী ওখানকার সাথে এটার কোনো মিল নেই। মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত থেকে আরম্ভ করে প্রত্যেকে যে মতপ্রকাশের সুযোগটা পাচ্ছে, এটা তো স্বাধীনতার পর থেকে পায়নি। যারা আসছে সবাই শোষণ করেছে। তারাই নিজের পেটুয়া বাহিনী গঠন করেছে। আগামীতে এ ধরনের কিছু হলে কেউ ছাড় দেবে না।'
এটা ঠিক ৭১ পর যে একটা সার্বিক অনিয়ম দুর্নীতির চিত্র তৈরি হয়েছিল দেশজুড়ে বর্তমান পরিস্থিতি সেরকম সেটি বলা যায় না। আবার কোনো বিপ্লব কিংবা অভ্যুত্থানের পর সার্বিক যে একটা ধাক্কা লাগে, তাতে শৃঙ্খলা আনতে সময়েরও প্রয়োজন সে ব্যাপারেও একই মত দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু বড় একটা কর্তৃত্ববাদী সরকারের পতনের পর চড়া দ্রব্যমূল্য, অনিয়ম-দুর্নীতির যে ধারাবাহিকতা চলছে, তাতে স্বস্তি কি সত্যিই আসবে? যখন আগের মতই দখলবাজি, নিয়ন্ত্রণবাজির অভিযোগ আসছে।
রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনৈতিক দলসহ গণঅভ্যুত্থানের বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে যে অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে, সেটি আশাব্যাঞ্জক নয়।
রাজনীতি বিশ্লেষক ড. দিলারা চৌধুরী বলেন, 'এই সুযোগটা হাতছাড়া হলে বাংলাদেশ আগামী ৫০ বছরের মধ্যে উঠে দাঁড়াতে পারবে না। এটা সবার বুঝা উচিত যে এটা কতটা সিরিয়াস। বাংলাদেশের কোনো বন্ধু নেই তো। চারিদিকে ভারত। ওদিকে মিয়ানমারে আরাকান আর্মি বর্ডারে চলে আসছে প্রায়। যেকোনো সময় রোহিঙ্গারা অনুপ্রবেশ করতে পারে। ওখানে চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রের দ্বন্দ্ব চলছে। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সমস্যা আমাদের সামনে। যারা দেশকে স্থিতিশীল রাখতে চায়, তাদের সবাইকে ধৈর্য ধরে, অন্তর্বর্তী সরকারসহ কারণ তাদেরও একটা রোডম্যাপের দরকার।'
এরই মধ্যে রাজনীতির মাঠে অভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তিগুলোর মধ্যে ক্ষমতার রাজনীতির প্রশ্নে দূরত্ব স্পষ্ট। এখন মা'কে বলে যাওয়া শহীদ সায়েমের স্বপ্নের 'ভালো বাংলাদেশ' কিংবা মেরুদণ্ডে বুলেট নিয়ে অনিশ্চিত আগামীর দিকে ধাবমান কিশোরের, বুক ফুলিয়ে চলার স্বপ্নের কতটা কাছাকাছি পৌঁছাতে পারবে বাংলাদেশ, তা নির্ভর করছে প্রতিটা পক্ষের পরিবর্তনের তীব্র আকাঙ্ক্ষার ওপর।