দীর্ঘ ১৩ বছরের গৃহযুদ্ধে দেশের মানুষের জীবনে যে অন্ধকার নেমেছিল, রাষ্ট্রপ্রধান হয়েও তা দেখতে চাননি বলেই হয়ত রাতের অন্ধকারে নিজের প্রাসাদ ছাড়তে হয়েছে ক্ষমতাচ্যুত বাশার আল-আসাদকে। দামেস্ক থেকে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন মস্কোতে।
২০১৫ সালে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে ক্ষমতাসীনদের পক্ষে অংশ নিয়ে আসাদ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মিত্রে পরিণত হয় রাশিয়া। আসাদ বাহিনীর প্রতিরক্ষায় বড় পরিসরে সামরিক সহযোগিতা দেয়ার পাশাপাশি জাতিসংঘে দামেস্কের কূটনৈতিক ঢাল হয়েছিল মস্কো। আসাদের ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার কৃতিত্বেরও বড় ভাগীদার রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।
এই সহযোগিতার বিনিময়ে সিরিয়ার টার্টুজে সামরিক ঘাঁটি সম্প্রসারণ করে রুশ নৌবাহিনী। ১৯৭১ সালে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের আমলে তৎকালীন সিরীয় প্রশাসনের সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে নির্মিত ঘাঁটিটি গেলো দশকে সম্প্রসারণের পাশাপাশি নিকটবর্তী মেইমিম বিমানঘাঁটিও ২০১৫ সাল থেকে পরিচালনা করছিল মস্কো।
দু'টি ঘাঁটিই সিরিয়ার ভূমধ্যসাগরীয় উপকূলের লাটাকিয়া প্রদেশে অবস্থিত এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গণে রাশিয়ার লক্ষ্য অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ বলে প্রমাণিত। আসাদ প্রশাসনের পক্ষে অভিযান পরিচালনার পাশাপাশি ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল ও আফ্রিকাজুড়ে মস্কোর প্রভাব বাড়াতে সাহায্য করেছে ঘাঁটি দু'টো। বিশেষ করে লিবিয়া, সুদান ও মধ্য আফ্রিকায় রাশিয়ার অবস্থান পুরোপুরি লাটাকিয়ানির্ভর।
গিগা ইনস্টিটিউট ফর মিডল ইস্ট স্টাডিজের সিরিয়াবিষয়ক বিশেষজ্ঞ আন্দ্রে ব্যাংক বলেন, ‘কয়েক দশকের মিত্র আসাদকে হারানোর পর এই ঘাঁটি দুটো কর্মক্ষম রাখা রাশিয়ার জন্য এই মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি আমি। কারণ ভূমধ্যসাগরে, বিশেষ করে পূর্বাঞ্চলে রাশিয়ার এটিই একমাত্র সামরিক ও বিমান ঘাঁটি। যেখানে একদিকে মধ্যপ্রাচ্যে একদম কেন্দ্রে মার্কিন সেনা, কাছেই ইসরাইল, তুরস্ক এবং অঞ্চলের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ শক্তিগুলো। তাই যেকোনো মূল্যে সিরিয়ায় নিজেদের ঘাঁটিগুলো রক্ষা করতে চাইবে রাশিয়া।’
বিশ্লেষকরা বলছেন, আসাদকে আশ্রয় দিলেও মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকায় নিজেদের নীতি বদলাতে চায় না বলে সিরিয়ায় ক্ষমতার পটপরিবর্তনের সাথে তাল মেলাবে আসাদের দীর্ঘকালের মিত্র পুতিন প্রশাসন। আসাদবিরোধী বিদ্রোহীদের গেলো সপ্তাহেই 'সন্ত্রাসী' আখ্যা দেয়া রাশিয়া তাই সুর পাল্টে এরই মধ্যে দামেস্কের নিয়ন্ত্রণকারীদের 'বিরোধী দল' হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতিও দিয়েছে।
গিগা ইনস্টিটিউট ফর মিডল ইস্ট স্টাডিজের সিরিয়াবিষয়ক বিশেষজ্ঞ আন্দ্রে ব্যাংক বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার নীতি বহাল থাকবে কী না বা এই ঘাঁটি দুটোর ভাগ্য কী হবে, তা এখনই নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব নয়। তবে আমার মনে হয় যে নতুন অন্তর্বর্তী সরকার বা সাবেক শাসকগোষ্ঠীর মধ্যস্থতাকারীদের সাথে আলোচনার উদ্যোগ নিতে পারে রাশিয়া।’
কর্তৃত্ববাদী শাসনের প্রশ্নে আসাদ-পুতিনের আরেক সমকক্ষ চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের প্রশাসনও কি কিছুটা নড়ে গেছে আসাদের পতনে? ইরান-রাশিয়ার মতো সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে সরাসরি সম্পৃক্ততা কখনোই ছিল না বেইজিংয়ের।
কিন্তু জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে বাশার আল-আসাদের নীরব মিত্রের ভূমিকা পালন করেছে জিনপিং প্রশাসন। নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হিসেবে সিরিয়া ইস্যুতে নানা প্রস্তাবে বরাবর ভেটো দিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আসাদের কূটনৈতিক ঢাল হয়ে থেকেছে বেইজিং।
আর্থিক সহযোগিতা-ত্রাণ-বিনিয়োগ ইত্যাদিতেও আসাদের সহযোগী ছিল চীন। ২০১৬ সালে মাত্র পাঁচ লাখ ডলার থেকে ১শ' গুণ বাড়িয়ে পরের বছরে সিরিয়াকে সাড়ে পাঁচ কোটি ডলারের ত্রাণ দেয় চীন।
২০১৮ সালে সিরিয়ার সর্ববৃহৎ বন্দর লাটাকিয়ায় ৮শ' ইলেক্ট্রিক্যাল পাওয়ার জেনারেটর দান এবং এ পর্যন্ত সিরিয়ার তেল ও গ্যাস খাতে ৩শ' কোটি ডলারের বেশি বিনিয়োগও করেছে বেইজিং।
বিশ্লেষকরা বলছেন, রাশিয়ার মতোই চীনও সিরিয়ার মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে প্রবেশ করতে চেয়েছিল মধ্যপ্রাচ্যে, আসাদের পতনে যা থমকে যেতে পারে। এই অচলাবস্থা এড়াতে পাঁচ দশকের স্বৈরশাসনের পর সিরিয়ার নতুন সরকারের সঙ্গে মস্কোর মতোই সহযোগিতার সম্পর্কের পথ বেছে নিতে পারে বেইজিংও।