রাস্তার পাশে তৃপ্তি সহকারে খাবার খায় কুকুর। চোখে-মুখে যেন তাদের রাজ্যের ক্ষুধা। পাশে দাঁড়িয়েই কুকুরগুলোকে খাবার দেন এক লোক। তার চোখে মুখেও খাওয়াতে পারার আনন্দ।
৬০ বছর বয়সী তাজুল ইসলাম পেশায় একজন রিকশা মিস্ত্রী। রাজধানীর একটি বস্তিতে তার বাস। পরিবারে আছে স্ত্রী সন্তান আর বেশকিছু পশুপাখি। রিকশা মেরামত করেই চলে তার সংসার। দিনে আয় করেন ৫০০ থেকে ৭০০ টাকার মতো।
তাজুল ইসলাম বলেন, ‘প্রায় ২০ থেকে ২২ বছর ধরে এই মেইন রাস্তার পাশে মিস্ত্রির কাজ করি। আমার বউ আছে। দুইজনের ওষুধ-পাতি লাগে, ডাক্তারের খরচ লাগে। দিনে ৫০০ টাকার মতো ইনকাম হয়। সংসারে চলা কষ্ট হয়ে যায়। কাজে এখন আর আগের মতো ইনকাম নেই। এখন অনেক সমস্যা হয়ে যায়, সমাধান করতে পারছি না।’
সূর্যটা ঢলে পড়ে পশ্চিম আকাশে। শহরে নামে রাত, নীরব হতে শুরু করে চারপাশ। নরম বালিশে মাথা গুঁজে ঘুমে কাতর থাকে অনেকেই। এমন নিস্তব্ধ সময়ে একটি ব্যাগ হাতে গুটিগুটি পায়ে তাজুল ইসলাম বেরিয়ে পরেন। তাকে দেখামাত্রই আশপাশ থেকে দৌড়ে আসতে শুরু করে রাস্তার কুকুরগুলো।
বয়োবৃদ্ধ তাজুল প্রতিদিনই খাবার নিয়ে আসেন রাস্তার কুকুরদের জন্য। হাতের ব্যাগ থেকে খাবার বের হতেই ক্ষুধার্ত কুকুরদের যেন আর বাঁধ মানে না। এজন্যই হয়তো কবি বলেছেন- নগরীর রাজপথে ব্যস্ততা কম গভীর রাতে, মানুষের বাঁচার যুদ্ধে- যুদ্ধক্ষেত্র হয় নগরী, দিবালোকে। অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের সন্ধানে পাগল হয়ে, কার আগে কে যাবে, কাকে মেরে কাকে খাবে।
তাজুল ইসলাম বলেন, ‘প্রথম লকডাউনে কুকুর অনাহারে ছিল। আল্লাহ ওদেরও সৃষ্টি করেছে, আমাকেও সৃষ্টি করেছে। ওদের ও চার হাত-পা দিয়ছে, আমাকেও চার হাত পা দিয়েছে। আমি কর্ম করতে পারি, ও কর্ম করতে পারে না। ওরা চাইতেও পারে না। মানুষ লাত্থি-উষ্টা মারে, এগুলো নির্যাতন সহ্য করেই ওরা টিকে আছে। ভালো লাগে দেখে আমি কুকুরকে আদর করি। প্রথম লকডাউন থেকেই আমি কুকুরদের খাওয়াই। বিভিন্ন জায়গায় খাওয়াই। আমার অর্থ দিয়ে আমি খাওয়াই। আমার যে কর্ম, মিস্ত্রির কাজ করে, এটা দিয়ে আমার চলে না। তারপরও আমি কষ্ট হলেও আমার নিজের সংসারের কষ্ট হলেও এগুলো করি।’
রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লার কথায়- তুমি বরং কুকুর পোষো, প্রভুভক্ত খুনসুটিতে, কাটবে তোমার নিবিড় সময়। হয়তো এ কারণেই স্বল্প আয়ের একটি অংশ দিয়ে সাত থেকে আট বছর ধরে পথকুকুরদের খাবার খাইয়ে থাকেন তাজুল ইসলাম। ছোট্ট জায়গায় আয়ের পরিমাণ সীমিত হওয়ার পরেও প্রাণীদের সাথে প্রেম ভাঙ্গেনি তার।
জীর্ণ-শীর্ণ বস্তিতে জীবন পার করা মানুষটির কাজে খুশি বস্তির স্থানীয়রাও।
বস্তিতে থাকা একজন বলেন, ‘উনি দিনে যা ইনকাম করেন তা থেকেই সে ওদের খাওয়ায়। কুকুরগুলো তার পরিবারের মতোই হয়ে গিয়েছে।’
অন্য একজন বলেন, ‘এটা তো ছোটখাট মানুষ দিয়ে হবে না। যারা বড়মাপের মানুষ, কামাই মানে টাকাটা দেখে না। সে নিজে না খেয়ে থাকলে কেউ দেখার নেই। কিন্তু কে অনাহারে আছে, কে না খেয়ে আছে তা সে দেখতেছে। তা তো পরিমাপ করার জায়গা নেই।’
নুন আনতে পান্তা ফুরানো সংসারে এমন কাজ অনুপ্রাণিত করেছে আরও অনেককে। তারাও এখন তাজুল ইসলামের মত রাতের আঁধারে খাবার খাওয়ান রাস্তার কুকুরদের।
গভীর রাতে মানুষ যখন নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত, ঠিক তখন গুটিকয়েক মানুষ ব্যস্ত রাস্তার পশুদের নিয়ে। প্রাণীদের প্রতি ভালোবাসার টানেই খাবার নিয়ে আসেন মধ্যরাতে। তাদের অনেকের সংসারের অবস্থাই নুন আনতে পান্তা ফুরানোর মতো। তবুও একদিন পৃথিবী হবে প্রাণীবান্ধব এমনই প্রত্যাশা এই প্রাণী দরদি মানুষগুলোর।