মার্শাল ল বা সামরিক আইন, দেশের যেকোনো জরুরি পরিস্থিতিতে সাময়িকভাবে সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব দেয়ার প্রক্রিয়াকে বোঝায়। সবশেষ ১৯৭৯ সালে সামরিক স্বৈরশাসক পার্ক চুং হি'কে সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে হত্যার পর দক্ষিণ কোরিয়ায় সামরিক শাসন জারি করা হয়েছিল। কিন্তু কোনো ধরনের আগ্রাসন কিংবা সংঘাত ছাড়া হঠাৎ করে কেন সামরিক আইন জারি করার প্রয়োজন পড়লো দক্ষিণ কোরিয়ার? পর্যবেক্ষকরা বলছেন, দেশের ওপর বহির্বিশ্ব, বিশেষ করে উত্তর কোরিয়ার হুমকির তুলনায় প্রেসিডেন্ট ইউন সুক ইওলের রাজনৈতিক সংকট বেশি হওয়ায় প্রতিক্রিয়ার কথা না ভেবেই এই ধরনের ঘোষণা দিয়ে বসেছিলেন ইওল।
বিশ্লেষকরা বলছেন, যে পরিস্থিতি তিনি তৈরি করেছেন, তাতে তিনি পদত্যাগ করতে না চাইলেও তাকে জোর করে গদি ছাড়া করা হতে পারে। তারা বলছেন, গণতন্ত্রে অনন্য এই দেশে তখনও মার্শাল ল জারি করা হয়নি, যখন উত্তর কোরিয়া তাদের লক্ষ্যবস্তুতে টার্গেট করে হামলা করেছে। সংবিধান অনুযায়ী, দেশে জরুরি কোনো পরিস্থিতিতে সামরিক আইন জারি করা হয়, বর্তমানে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। বিশ্লেষকরা বলছেন, এই বেপরোয়া উদ্যোগের মাশুল দিতে হবে প্রেসিডেন্টকে ইওলকে।
রাজনীতি বিশ্লেষক সেলেস্টি অ্যারিংটন বলেন, ‘অদক্ষ রাজনীতিবিদের মতো পদক্ষেপ নিয়ে বসেছেন ইওল। তার হতাশ রয়েছে। কিন্তু সংবিধানে কোন পর্যায়ে জরুরি পরিস্থিতি তৈরি হলে মার্শাল ল দেয়া যায়, তিনি জানেন না। জাতীয় পরিষদে বিরোধী দল প্রতিনিধিত্ব করছে। দক্ষিণ কোরিয়ার ইতিহাসে তার মতো ভেটো কেউ পায়নি।’
এপ্রিলের নির্বাচনের পর থেকে তার জনপ্রিয়তা কমে যাওয়ায় বর্তমানে পার্লামেন্টের সাধারণ পরিষদেও ডেমোক্রেটিক পার্টির আধিপত্য। এই দল ইউন সুক ইওলের মন্ত্রিসভার অনেক সদস্যের অভিশংসন চান। প্রেসিডেন্ট সামরিক আইন জারি করে বিতর্কিত হওয়ার পর তার বিরুদ্ধে উঠে আসছে নানা তথ্য। এছাড়াও, দক্ষিণ কোরিয়াকে অস্থিতিশীল করতে দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কাজ করতে পারে উত্তর কোরিয়ার গুপ্তচর।
রাজনীতি বিশ্লেষক সেলেস্টি অ্যারিংটন আরো বলেন, ‘উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে ইতিহাসে কোনো সময় দক্ষিণ কোরিয়ার সম্পর্ক ভালো ছিল না। হতে পারে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে উত্তর কোরিয়ার গোয়েন্দারা রয়েছে, যারা রাজনীতিতে প্রভাব ফেলছে।’
কোরীয় উপত্যকায় যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ মিত্র দেশগুলোর একটি দক্ষিণ কোরিয়া। সিউল অস্থিতিশীল হলে প্রভাব পড়বে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর। পাশাপাশি ট্রাম্পকে নিয়ে বেশ অস্থিরতা বিরাজ করছে কোরিয়ার সাধারণ মানুষের মধ্যেও। ইওলের সামরিক শাসন জারির এই উদ্যোগ সহজ করে দিলো অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করার পথ।
সেলেস্টি অ্যারিংটন বলেন, ‘সিউলে এবার ওয়াশিংটনের অবস্থান প্রভাবিত হবে। চীন, উত্তর কোরিয়া, রাশিয়া এই অঞ্চলে অনেকটাই জোটবদ্ধ, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দক্ষিণ কোরিয়া। এই অঞ্চল নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ সংশ্লিষ্টতা আছে। উত্তর পূর্ব এশিয়াতে বাইডেন প্রশাসনের প্রভাব কমে যেতে পারে। ট্রাম্প নিয়েও অনিশ্চয়তায় আছে কোরিয়ানরা। উত্তর কোরিয়া, রাশিয়া আর চীনকে এই মার্শাল ল ইস্যুতে সুযোগ করে দিলেন ইউন সুক ইওল।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ধরনের আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত রাজনীতির ক্যারিয়ারের আত্মহত্যার শামিল। এই মার্শাল ল নিরাপত্তা আর অর্থনীতিতে এরমধ্যেই ঝুঁকি তৈরি করে ফেলেছে। নিরাপত্তা ঝুঁকিতে এখন ক্ষতিগ্রস্ত হবে সেমিকন্ডাক্টার ও ব্যাটারির সরবরাহ ব্যবস্থা। খোদ পিপল পাওয়ার পার্টির সাবেক নেতারা বলছেন, ক্ষমতায় আর টিকতে পারবেন না ইউন সুক ইওল। উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে গিয়ে নিজ দেশেই ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পথে দক্ষিণ কোরীয় প্রেসিডেন্ট।