দেশে এখন
0

হেমন্ত, প্রাচীন অর্থনীতি-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের এক সেতুবন্ধন

হেমন্ত ঋতু গ্রাম ও শহরে নিয়ে আসে আলাদা আলাদা স্বপ্ন। প্রকৃতির কোলে সোনালি ধানের ঘ্রাণ, শিশিরে ভেজা সকাল আর রঙিন ফুলের সৌন্দর্যে ভরে ওঠে দিগন্তজোড়া মাঠ। কৃষকের ঘরে আসে তৃপ্তি- ঋণ শোধের স্বস্তি, সন্তানের বায়না পূরণের আনন্দ। অন্যদিকে, শহরের হেমন্তে জেগে ওঠে শুভ্রতা ও শীতল বাতাসের আবেশ। এই ঋতু প্রাচীন অর্থনীতি আর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের এক সেতুবন্ধন।

প্রথম ফসল গেছে ঘরে, হেমন্তের মাঠে মাঠে ঝরে শিশিরের জল। জল আর মাটি যে ফসলকে পরিপক্ব করে তুলেছে, সেই পাকা ফসল এখন তোলার পালা। কাজ চলে ভোর থেকেই, শীতের সেই শিশির টের পাওয়া যায় কৃষকের আঙিনায়। তবু আড়মোড়া ভাঙে যারা এসেছে মাঠে, তাদের মনে আনন্দের কমতি নেই। কারণ এ যে হেমন্ত। উঠবে নতুন ফসল, মিটবে ঋণ।

এখানেও বইছে শীতল বাতাস। হেমন্তের নতুন ফসল আরেকটু সচ্ছল করে কৃষককে। অনেক দিনের বায়না জমা সন্তানের কিংবা স্ত্রীর শখের কানের দুল কিনবার সময় যেন এখনই। তাই তো কৃষকের চোখে ফুটে উঠেছে তৃপ্তির ছায়া।

একজন কৃষক বলেন, 'যখন নতুন ধান আমরা লাগাই আবার যখন দান কাটি তখন আমাদের মনের ভেতর একটা ফুরতি লাগে। মনটা চায় সবাইকে দিয়ে আমরা খাই।'

অন্য একজন কৃষক বলেন, 'নতুন ধান তুলে বিক্রি করার পর মেয়ের জন্য, ছেলের জন্য, বউয়ের জন্য কাপড় কিনে না হয়।'

দিগন্তজোড়া মাঠে ভেসে আসে কৃষাণীর সুর। কুমড়ো শাকের ক্ষেতের দায়িত্বটা যেন তার। সকালের রান্না শেষে সেও যায় মাঠে। বেলা বাড়লে কৃষক আসে সঙ্গিনীর খোঁজে।

একজন কৃষক বলেন, 'সাড়ে তিন লাখ টাকার লাউশাক বিক্রি করেছি। প্রায় আড়াই লাখ টাকা লাভ হয়েছে। আল্লাহর রহমতে এখন ধানক্ষেত শেষ হইলে আলুক্ষেত করবো।'

হেমন্তের রঙিন ফুল ফুটে থাকে অরণ্যের আনাচে-কানাচে। এ ঋতুতে ফোটে কামিনী, হিমঝুরি, দেব কাঞ্চন, রাজ অশোক, ছাতিম, সোনাপাতি, লতাপারুল, বকফুলের মত ফুলে ঋতুর রূপ হয়ে উঠে জীবন্ত।

অন্যদিকে যারা ফসল ঘরে তুলেছে, তাদের ঘরে এখন উৎসবের আমেজ। পিঠাপুলি আর মিষ্টিমুখের ধুম লেগেছে। চাল বাটার শব্দ আর পিঠার মিষ্টি ঘ্রাণে ভরে উঠেছে উঠান।

একজন গৃহিণী বলেন, 'আমন ধানের পিঠা স্বাদ বেশি, ইরি ধানের পিঠা স্বাদ লাগে না। এখন কলে ভাঙিয়ে সেই আটা দিয়ে খাওয়া হয়। আগে ঢেঁকিতে চাল ভেঙে আটা করে পিঠা খাওয়া হতো।'

হেমন্ত আর কৃষকের সম্পর্ক যেন পৃথিবীর মতোই প্রাচীন। আধুনিক জীবনে হেমন্তের আবেদন অনেকাংশে ফিকে হলেও, কৃষকের সন্তান এখনও এই ঋতুর অপেক্ষায় দিন গুণে।

অর্থনীতিবিদ ড. শহীদুল জাহীদ বলেন, 'নতুন ধান লাগিয়েছে, সেই ধানটা কবে উঠবে কৃষানি থেকে শুরু করে একজন কৃষকের ছেলে মেয়ে পাড়া-প্রতিবেশি, তার পাওনাদার সবাই প্রহর গুণতো যে এই নতুন ধান করে উঠবে।'

হেমন্তের কবি বলা হয় জীবনানন্দ দাশকে। তার কবিতায় বারবার এসেছে কার্তিক আর অগ্রহায়ণের কথা। তিনি এ ঋতুর সুখ-দুঃখ, আলো-আঁধারকে তুলে ধরেছেন অপূর্ব সূক্ষ্মতায়। কেন তিনি হেমন্তের প্রেমে পড়েছিলেন, জানতে মন চায়, কেন হেমন্তের প্রেমে পড়েছিলেন এ কবি?

সাহিত্য গবেষক ও অর্থনীতিবিদ ফয়জুল লতিফ চৌধুরী বলেন, 'নবান্নেরে দেশে কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসবো এ কাঁঠাল ছায়ায়। এখন কাঁঠালের ছায়া, কাঁঠাল বললেই আমাদের জ্যৈষ্ঠ মাসের কথা মনে পড়ে কিন্তু এখানে হেমন্তের সঙ্গে তিনি সংযুক্ত করেছেন। আবার বনলতা সেনে আছে শিশিরের শব্দের মতো সন্ধ্যা আসে, এখন শিশির হয়তো পড়ে কিন্তু আমাদের তো এখন টিনের চাল নেই। শিশির যে পড়ছে আমরা কী করে বুঝবো।'

সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতো

সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;

পৃথিবীর সব রং নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন

তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল।

এসএস