হাটবাজারের খরচে মধ্যম আয়ের মানুষের খুব একটা চাপ না হলেও গত ১৫ বছরে তা বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে স্বল্প ও নিম্নআয়ের মানুষের। ছয় শতাংশের মূল্যস্ফীতি দেড় যুগে ছাড়িয়েছে ১২ শতাংশের বেশি।
পায়ে হেঁটে গত ২০ বছর আগে গামছা বিক্রি করে একজন ভ্রমণকারী বিক্রেতা না যতটা ভালো ছিলেন। তিনিও এখন টিভিকে জানালেন টানাপোড়েনের কথা। আবার দুই যুগ ধরে ছোট টঙ দোকান বা রিকশা চালানো ব্যক্তিও ১৫ বছরে আয়ের থেকে ব্যয় বেশি বৃদ্ধির ক্ষোভ প্রকাশ করলেন।
একজন রিকশাচালক বলেন, '১৫ বছর আগে যে ইনকাম করতাম তাতে ৩০০ টাকা তখন পাইলে যা হতো, এখন এক হাজার টাকার ভাড়া চালানোর পরও সেই একই জিনিস। এখন টাকা আগের চেয়ে বেশি ইনকাম হচ্ছে কিন্তু তাতে তো কোনো লাভ হচ্ছে না।'
ভুল নীতিতে একের পর এক অবকাঠামো উন্নয়নে রাষ্ট্রের যতটা না আয় হওয়ার কথা তার থেকে লোকসান গুণতে হচ্ছে কয়েক গুণ। মেট্রোরেল বা পদ্মা সেতুর মতো প্রয়োজনীয় প্রকল্প ইতিবাচক ভূমিকা রাখলেও মাথাপিছু ঋণের বোঝা বাড়িয়েছে কর্ণফুলী টানেল বা পদ্মার রেল সংযোগের মত কর্মকাণ্ড। ফলে নাজুক অবস্থায় রয়েছে সামষ্টিক অর্থনীতি।
শুধু সামষ্টিক নয়, এ খাতের তারল্য আর মূলধনী বাজারের অবস্থাও এখন অনেকটাই তলানিতে। গত ১৫ বছরে আওয়ামী সরকার অবৈধভাবে ব্যাংক দখলের সুযোগ দিয়েছে অনেককেই। এতে একদিকে খেলাপি ঋণ আর অর্থ আত্মসাতের পাহাড় গড়েছে এস আলম, নজরুল ইসলাম মজুমদার আর সালমান এফ রহমানের মত অসাধুরা। আর শেখ হাসিনা সরকারের পতনে টাকা না পেয়ে হতাশ হচ্ছেন গ্রাহকরা।
ব্যাংকে সেবা নিতে আসা একজন গ্রাহক বলেন, 'সরকারে পতনের কারণে, আর টাকা লুটপাটের কারণে ব্যাংক ক্ষতিগ্রস্ত আর এর সাথে আমরাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। একদিন দুইদিনে না অনেক বছর যাবৎই এই জিনিসটা লুট হয়েছে।'
অন্য একজন গ্রাহক বলেন, 'ব্যাংকগুলো সরকারের পক্ষপাতিত্ব করেছে। এতে টাকা পাচার হয়েছে। আর টাকা পাচার হয়ে যাওয়ার কারণেই তো আমাদের এই সংকটটা দেখা দিয়েছে।'
ব্যাংকের মত পুঁজিবাজারেও সালমান এফ রহমান, এস আলম ও কারসাজি চক্রকে সুবিধা দিতে নেয়া হয়েছে হুটহাট সিদ্ধান্ত। আওয়ামী সরকারের নিয়োগ দেয়া খায়রুল ও শিবলী কমিশনারদের ভুল সিদ্ধান্তে আস্থা হারিয়েছে বিনিয়োগকারী। আর ২০১০ এর ধস ও গত ১৫ বছরে খারাপ কোম্পানির শেয়ারের কারণে এ বাজার আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি।
একজন বিনিয়োগকারী বলেন, 'ফ্লোর প্রাইজ বা অন্যান্য যে বিষয়গুলো করা হয়েছে এগুলো মার্কেটের জন্য অবশ্যই অনেক বড় ক্ষতি হয়েছে।'
অর্থনীতির সব খাতে আওয়ামী সরকারের একের পর এক সুবিধাভোগী সিদ্ধান্তে কষ্টে থাকা মানুষের অভিযোগের সংখ্যাই বেড়েছে গত ১৫ বছরে।
অপরিকল্পিত অবকাঠামো উন্নয়নের মত ব্যাংক খাতে নেয়া সব সিদ্ধান্তেই ঘাটতি ছিল বলে জানান ব্যাংকাররা। সব সিদ্ধান্তই যেমন ভুল ছিল, তেমনি বড় ক্ষতি করেছে ব্যাংক দখল, ঋণ নিয়ে খেলাপি হওয়া আর অর্থ আত্মসাতের সুযোগ দেয়া।
ব্যাংকিং বিশেষজ্ঞ ফারুক মঈনউদ্দিন বলেন, 'ব্যাংক খাতের যদি আমরা বিভিন্ন ভুল সিদ্ধান্ত বলি, তাহলে আমরা অনেকগুলো বলতে পারবো। ছোট-বড় প্রচুর ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। ঋণ খেলাপিদের নামমাত্র ডাউন পেমেন্ট দিয়ে তাদের ফিরিয়ে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করে দেয়ার বিষয়গুলো খুব আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত ছিল ব্যাংকের জন্য। সময়সীমা যেটা বাড়ানো হয়েছে তাতে করেও খেলাপি ঋণ লুকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এ দু'টি বড় সিদ্ধান্ত ব্যাংকগুলোকে তলে তলে খেয়ে ফেলেছিল।'
সেই সাথে অস্তিত্ব নেই এমন কোম্পানিকে তালিকাভুক্ত হয়ে অর্থ তোলার সুযোগ দেয়া আর আইনে ছাড় দিয়ে কারসাজিকারিদের সুবিধা দেয়ার কারণে শেয়ারবাজার বিনিয়োগকারী হারিয়েছে বলে জানিয়েছেন এ খাতের ব্যবসায়ীরা।
পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ মিনহাজ মান্নান ইমন বলেন, 'যত আইনই করা হোক আর যত সংস্কারের কথা বলা হোক, আসলে কোনোটাই কিন্তু কাজে আসেনি। গত ১৫ বছরে আমরা দেখেছি বাজারের সবচেয়ে মূল উপাদান আইপিও, সেই মানসম্পন্ন আইপিও আসেনি। নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছে এই ১৫ বছরে যেসব আইনি বিধানগুলো দেখেছি সেটা বাজারবান্ধব কতটা ছিল সেই প্রশ্ন কিন্তু এখন সামনে চলে এসেছে।'
এদিকে সামষ্টিক অর্থনীতি, ব্যাংক ও শেয়ারবাজারসহ সব খাতে আওয়ামী সরকারের নেয়া ভুল সিদ্ধান্তের কারণে সাধারণ মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত বলছেন অর্থনীতিবিদরা।
অর্থনীতিবিদ ড. মো. শহিদুল ইসলাম জাহিদ বলেন, 'বিগত সরকারের সময়ে বা নিকট অতীতে দেশ ও জাতির উন্নয়নে যেসমস্ত ভৌত অবকাঠামোগত যে প্রজেক্টগুলো নেয়া হয়েছে সেগুলোর সুফল আসলে দেশের সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছাতে পারছে না। নিকট অতীতে আসলে হরিলুট হয়েছে। এখানে পুকুর চুরি না, এখানে আসলে সাগর সমপরিমাণ চুরি হয়ে গেছে। কিছু কোম্পানিকে সুযোগ দেয়া হয়েছিল পুঁজিবাজার থেকে পুঁজি উত্তোলনের জন্য কিন্তু সেসমস্ত কোম্পানির সঠিক যোগ্যতা ছিল কিনা সেটা কিন্তু দেখা হয়নি।'
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত দেড় যুগে শেখ হাসিনা সরকারের শাসনে বেশিরভাগ সিদ্ধান্ত সুবিধা ভোগের জন্যই নেয়া হয়েছে। এতে গতি হারিয়েছে অর্থনীতি। তাই এই খাতকে দুর্দশা থেকে বের করে আনতে সব রাজনৈতিক দলকে নৈতিকতার সাথে কাজ করার পরামর্শ তাদের।