বিশেষ প্রতিবেদন
0

মুখ থুবড়ে পড়েছে অবকাঠামো, আদৌ কি চালু হবে বিআরটি সেবা?

আবর্জনার স্তূপ তার ভেতরে ভবঘুরেদের বসবাস। হস্তান্তরের আগেই দীর্ঘশ্বাসে পরিণত হয়েছে ঢাক-ঢোল পেটানো জয়দেবপুর থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত দেশের প্রথম বিআরটি প্রকল্প। ২৫টি স্টেশনসহ এ প্রকল্পের বিভিন্ন অবকাঠামো এমনভাবে জীর্ণ যে; তাতে প্রশ্ন উঠেছে, আদৌ এখানে বিশেষায়িত বিআরটি সেবা চালু হবে কি-না? তবে বাস্তব পরিস্থিতি যাই হোক, এই ডিসেম্বরেই প্রকল্প হস্তান্তরের পরিকল্পনা নিচ্ছে কর্তৃপক্ষ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নতুন করে খরচ না বাড়িয়ে বিদেশি কোম্পানিকে দেয়া হোক বিশেষায়িত বাস পরিচালনার দায়িত্ব।

বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট প্রকল্পের শেষ প্রান্ত গাজীপুরের জয়দেবপুর ইন্টারসেকশন। শ্রমিকদের ব্যস্ততাকে তুলনা করা যায়, দ্রুতগামী, শব্দহীন, দূষণহীন এক যোগাযোগ অবকাঠামোর স্বপ্নকে জাগ্রত রাখার শেষ প্রচেষ্টা হিসেবে। লোক দেখানো প্রকল্প, দায়সারা নির্মাণ আর শত ভোগান্তির জঞ্জালে যে স্বপ্ন বাঁধা পড়ে আছে, এক যুগেরও বেশি সময় ধরে।

দেশের প্রথম বিআরটি প্রকল্প আদৌ কি আলোর মুখ দেখবে কি না, এ আলোচনা যখন চাউর ভেতরে বাইরে, তখন এর সবশেষ পরিস্থিতি দেখতে, দু'সপ্তাহ আগে আমরা জয়দেবপুর চৌরাস্তায়। শেষ স্প্যানের কাজ চললেও পরিস্থিতি যে কতটা নড়বড়ে তা শ্রমিকদের কথায়ও স্পষ্ট।

শ্রমিকদের একজন বলেন, ‘শিপমেন্ট আসতে দেখা গিয়েছে ৬ মাস থেকে ১ বছর সময় লেগেছে। তখন আসলে কাজের ধির গতি হয়েছে।’

মূলত, প্রশ্নবিদ্ধ প্রকল্পের একটা স্মারক হয়ে উঠেছে, গাজীপুর থেকে বিমানবন্দর ২০ কিলোমিটারের এই বিআরটি প্রকল্প। ২০১২ থেকে ২০১৬ সাল মেয়াদি এই প্রকল্পটি শুধু মেয়াদের দিক থেকে দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প হিসেবে রেকর্ড করেনি, একইসঙ্গে রেকর্ড করেছে ব্যয়ের দিক থেকেও এবং এই প্রকল্পটি শহরতলির মানুষের কতটা স্বপ্নভঙ্গ করেছে তা বুঝতে নজর দিতে হবে এই প্রকল্পের বিবরণীর দিকে। যেখানে বলা হয়েছিলো নতুন যুগের একটি আধুনিক পরিবহণ সংস্কৃতি গড়ে তোলার কথা।

বলা হয়েছিল, এভাবে বদলে যাবে শহরতলি। অভিজাত নগর পরিবহন সেবা দিতে থাকবে বিশেষায়িত এমন বাস সার্ভিস। গণমানুষের জন্য এই বাসগুলো শুধু আলাদা, উৎসর্গিত লেন ধরে যাতায়াত করবে না, চওড়া হবে ভারি শিল্প এলাকা দিয়ে যাওয়া সাধারণ সড়কও। উন্নত হবে ড্রেনেজ ব্যবস্থা।

মেট্রোরেলের মত উন্নত আর আধুনিক এমন স্টেশন দিয়ে রাজধানীতে যাতায়াত করবে উপশহরের মানুষেরা। কিন্তু বাস্তবায়ন সংস্থার পক্ষ থেকে যখন বলা হচ্ছে, কাজ শেষ, বাকি আর মাত্র ৩ শতাংশ, তখন আসলে বাস্তব অবস্থা কী?

আমরা জয়দেবপুর থেকে বিমানবন্দরের দিকে, প্রথম বিআরটি স্টেশনে এসেছি। আমরা দেখছি যে নির্মাণ হওয়ার আগেই মূলত স্টেশনটি ভবঘুরেদের একটা আশ্রয়কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে এবং তীব্র গন্ধ আছে এর চারপাশে। গাড়িগুলোকে অবৈধ পার্কিং করে রাখা হয়েছেই, এছাড়া দেখছি যে, পুরো এলাকাটি একটা ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। পলিথিন, প্লাস্টিকসহ এলাকার যত আবর্জনা রয়েছে, সবগুলোই কিন্তু এভাবেই স্তূপ করে রাখা হয়েছে।

জয়দেবপুর থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত বিআরটি ২৫টি স্টেশনের চিত্রই এমন পরিত্যক্ত। ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে কিছু স্টেশন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এটা ঠিক, কিন্তু সেটা বাদ দিলেও দেখা যায়নি এসব স্থাপনা রক্ষণাবেক্ষণে টেকসই কোন উদ্যোগ। সব মিলিয়ে হতাশ এপথে চলাচলকারী ও ভুক্তভোগী স্থানীয়রা।

চালকদের একজন বলেন, ‘প্রচুর জ্যাম হয়। জ্যামের কারণে এই লেনটা ভেঙ্গে দেয়া দরকার।’

বাস্তবতা আর কাগুজে অগ্রগতির এমন প্রেক্ষাপটে, এ প্রকল্পের ভবিষ্যৎ কী? জীর্ণ এমন পরিস্থিতিতে হস্তান্তর হবে নাকি সম্পূর্ণ বাণিজ্যিক ব্যবহারের উপযোগী হলে? এটি কি আদৌ চালু হবে, তাহলে বিআরটির বাস নামবে নাকি প্রচলিত যানবাহনই চলবে? এসব বিষয় নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জানতে চাইলে তাদের এমন নির্বাক অবস্থা।

পরে কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার আমাদের জানান, তারা এপ্রিল নাগাদ বিআরটির এই নতুন রুটে বাণিজ্যিক চলাচল শুরু করতে চান। কিন্তু যখন, বিভিন্ন পক্ষ থেকে এ প্রকল্পে আর না আগানোর পরামর্শ আসছে?

ঢাকা বিআরটি কোম্পানি লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক মো. মহিউদ্দিন বলেন, ‘কর্তৃপক্ষ যদি বাদ দিতে চাই তাহলে তারা যেকোনো সময় বাদ দিতে পারে। একটা প্রকল্প যেখানে ৯৭ শতাংশ কাজ শেষ হয়ে গিয়েছে।’

এটা ঠিক দুই দফা সংশোধনের পর এ প্রকল্পের ব্যয় দাড়িয়েছে দুই হাজার থেকে ৪ হাজার কোটি টাকায়, যার সিংহভাগ অর্থের ছা্ড়ও হয়েছে এরই মধ্যে। এমন অবস্থায় পরিবহন বিশেষজ্ঞদের মত শেষমেষ বিআরটি চালু করার পক্ষে। যদিও সরকারিভাবে বাস ক্রয়ের বিপক্ষে তারা।

পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. মো. হাদিউজ্জামান বলেন, ‘ফিজিক্যাল ওয়ার্ক যেটা আছে সেটা দ্রুত শেষ করতে হবে। যদি আমরা অপারেটর নিয়ে আসতে পারি তাহলে টেন্ডারে যাওয়া, বাস কেনা এই ঝামেলায় পড়তে হবে না।’

পোশাক শিল্পের পণ্য ও কাঁচামাল পরিবহন ও ঢাকা ময়মনসিংহ সড়ক এই একই বিআরটি রুটের পড়ায়, কোন ভাবে বিআরটি চালু হলে এই সড়কে দুর্ঘটনা ও যানজট তীব্র হওয়ার শঙ্কা করা হচ্ছে বিভিন্ন পক্ষ থেকে যখন আবার পুরো প্রকল্পের বিভিন্ন দিকে এক ধরনের জোরতালি অবস্থা।

এমন অবস্থায়, এই প্রকল্পে প্রস্তাবিত বিআরটির বিশেষায়িত বাস চলবে কি না, নাকি সাধারণ বাস চলবে, নাকি আগের মতই প্রচলিত সড়ক হিসেবে ছেড়ে দেয়া হবে, সেটি হলে, কোটি কোটি টাকা খরচ করা এমন স্থাপনার ভবিষ্যৎ কী হবে, এসব দুরবস্থার জন্য দায়ী না থাকলে তা ঠিক করার দায়িত্ব পড়ছে অন্তর্বর্তী সরকারের সিদ্ধান্তের ওপরই।

ইএ