সবুজের বুক চিরে ইট পাথর আর কংক্রিটের অবকাঠামো। গ্রামীণ খোলামেলা পরিবেশে নির্মিত এ স্থাপনায় আলো বাতাসের কমতি না থাকার পরও এত এত শীতাতপ যন্ত্রের উপস্থিতি বলে দেয়, আধুনিকতার সঙ্গে বিলাসিতার নিবিড় সংযোগ হয়েছে এখানে।
প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর অধীনে ৪০টি উপজেলায় এমন ৪০টি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও চট্টগ্রামে একটি ইনস্টিটিউট অব মেরিন টেকনোলজি স্থাপনে প্রকল্প একনেকে অনুমোদন হয় ২০১৫ সালের নভেম্বরে। এর মধ্যে প্রথম ধাপে ২৪টি উপজেলায় এসব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র উদ্বোধন করেন ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তারই একটি রংপুরের গঙ্গাচড়ার এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটি।
২০২২ সালের জুলাই মাসে এই টিটিসি উদ্বোধন হলেও, ২ বছরে পুরোদমে কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি রংপুরের দুটি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। অবাক করার বিষয় এর মধ্যে একটি সাবেক প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করলেও এখনো যার নির্মাণকাজই শেষ হয়নি। কাগজে কলমে এটির শতভাগ কার্যক্রম চালু থাকলেও বাস্তবে এখনো হস্তান্তরই করেনি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। তবে দুটি ট্রেডে প্রশিক্ষণ চলছে একপ্রকার কচ্ছপ গতিতে।
এক প্রকল্পের আওতায় সারাদেশে এমন ৪০ টিটিসি নির্মাণে খরচ করা হয় এক হাজার ৬৬৭ কোটি টাকা। সে হিসেবে প্রতিটির নির্মাণব্যয় দাঁড়ায় ৪১ কোটি সাড়ে ৬৭ লাখ টাকা। রাষ্ট্রের এত টাকা খরচ করে বানানো এসব টিটিসির প্রতিটিতে একজন অধ্যক্ষ ও একজন প্রশিক্ষকসহ রাজস্ব খাতভুক্ত জনবল মাত্র ৪ জন। ছয়টি ট্রেডে প্রশিক্ষণ দেয়ার কথা থাকলেও ঢিমেতালে প্রশিক্ষণ চলছে ২ ট্রেডে। ল্যাবে অলস পড়ে আছে সরঞ্জাম। ধুলো জমা আসবাব বলে দেয় কীভাবে অপচয় হচ্ছে রাষ্ট্রীয় সম্পদ।
গঙ্গাচড়া কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের সুলতান মাহমুদ অধ্যক্ষ বলেন, ‘সবগুলো ল্যাবের ইনস্টলেশন হয় নাই আর সবগুলো ল্যাবের মালামাল এখনো আসে নাই, আমার এখানে গার্মেন্টস, ইলেকট্রিক্যাল ও কম্পিউটার ট্রেডের মালামাল এসেছে এবং ওগুলো ইন্সটল করা হচ্ছে ’এসব প্রকল্পের মূল লক্ষ্য বিদেশগামী কর্মীদের দক্ষ করে গড়ে তোলা হলেও রংপুরের পিরগঞ্জ আর গঙ্গাচড়ায় নেই তেমন কোনো প্রশিক্ষণ কিংবা প্রচারণা। বিদেশে যাবার আগে তিনদিনের প্রাক বহির্গমন প্রশিক্ষণও বন্ধ শিক্ষার্থীর অভাবে। সম্ভাবনার আলো দেখানো এসব প্রকল্পের নিচেই যেনো গভীর অন্ধকার।
অধ্যক্ষ, রংপুর কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র মো. নাজমুল হক ‘জনগণ ও ট্রেনিংয়ের ইকুপমেন্টস না থাকার কারণেই টিটিসিগুলো পুরোপুরি সচল ভূমিকা পালন করতে পাড়ছে না। দ্রুততার সঙ্গে যদি জনবল নিয়োগ দেয়া হয় এবং যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হয় তাহলে টিটিসিগুলো পুরো দমে দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ দিতে পারবে’
২০২৫ সালের মধ্যে প্রত্যেক উপজেলায় একটি করে কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নির্মাণের নির্দেশনা রয়েছে। তবে উত্তরাঞ্চলের দেশগামী কর্মীদের দক্ষতা বাড়াতে প্রতিষ্ঠিত এ টিটিসিগুলোর এমন নাজুক অবস্থার পেছনে প্রতারণার মানসিকতাকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এসব প্রকল্পে সত্যিকারের উপকারভোগী না বাড়িয়ে রাজনৈতিক ডামাডোলের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে পতিত সরকার।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক খালেদ সাইফুল্লাহ বলেন, ‘আসলে আমাদের আগ্রহটা থাকে শুধু চালু করা পর্যন্ত। তবে চালু করার পর যথাযথভাবে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে কিনা এবং যে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার কথা তা তৈরি হচ্ছে কিনা সেটাই দেখা হচ্ছে না। এর পাশাপাশি যারা দক্ষ জনশক্তি রূপে দেশের বাহিরে গিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা পাঠানোর কথা তারা আদৌ বাহিরে যাচ্ছে সেদিকে আমাদের নজর প্রয়োজন।’
রেমিট্যান্স প্রবাহ আর বৈদেশিক কর্মসংস্থানে উত্তরাঞ্চল পিছিয়ে থাকায় এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলো হতে পারতো আর্থিক সমৃদ্ধির বড় হাতিয়ার। কিন্তু শিক্ষক নিয়োগ, ল্যাব চালু আর প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পুরোদমে চালু করা না গেলে এসব ইট, পাথর আর কংক্রিটের কঙ্কাল হয়ে থাকবে উন্নয়নের নামে বিষফোঁড়ার উদাহরণ।