চিকিৎসাধীন অবস্থায় রোগীর মৃত্যু ঘিরে হাসপাতাল ও চিকিৎসকদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটছে হরহামেশাই । এ অবস্থায় স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন করার দাবি জানিয়ে আসছে খাত সংশ্লিষ্টরা।
'স্বাস্থ্য সেবা ও সুরক্ষা আইন, ২০২৪ প্রণয়নকল্পে প্রণীত অধ্যাদেশ' নিয়ে সবমহলে চলছে আলোচনা-পর্যালোচনা। চিকিৎসক কিংবা সেবা গ্রহীতাদের প্রশ্ন- কতটা সুরক্ষা নিশ্চিত করবে এই আইন?
স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এ আইনে গুরুত্ব পেয়েছে চিকিৎসকদের সুরক্ষা। অথচ রোগীর সুরক্ষার কথা সেভাবে নেই। চিকিৎসকের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকলে সরাসরি আমলে নেবে না আদালত। যদিও পাশের দেশ ভারতের ভোক্তা অধিকার আইনে-ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারে রোগী।
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইনের খসড়া প্রস্তাবনায় রয়েছে বহু ফাঁক-ফোকর। এ নিয়ে পর্যাপ্ত গবেষণা ও সংশ্লিষ্টদের মতামত নেয়া হয়নি। এতে চিকিৎসক ও রোগী কোনো পক্ষই উপকৃত হবে না।
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শিশির মনির বলেন, ‘রেজিস্টার সংরক্ষণ করতে হবে এটাও নাকি আইনের সাবজেক্ট মেটার। আইনের ৪০ নম্বরে আছে ক্যামেরায় গৃহীত ছবি, রেকর্ডকৃত কথাবার্তা ইত্যাদি স্বাক্ষ্যমূল্য। এগুলো সবগুলো তো এভিডেন্স অ্যাক্টে অ্যাপ্লিকেশন। ওসিকে তথ্য দিতে হবে এটাও নাকি আইনের সাবজেক্ট মেটার। ফলে মনে হয় এই আইন অতিরিক্ত বারডেম করে ফেলেছে।’
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরি বলেন, ‘এখনও তো আইন প্রণয়ন হয়নি। এটি খসড়া রয়েছে, সেই খসড়াতে অনেক ভুলও আমরা দেখতে পেয়েছি। এখানে অসামঞ্জস্যতা রয়েছে।’
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. মাসুদ আরেফিন বলেন, ‘ভোক্তারা কিন্তু আমাদের কাছে অভিযোগ করেন। যদিও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনে এই চিকিৎসা সেবা নিয়ে সরাসরি ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ নেই।’
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. আবু জামিল ফয়সাল বলেন, ‘ডাক্তার এবং রোগী, দুই দলেরই সরক্ষার অবস্থার কথা বলছি আমরা।’
আলোচিত স্বাস্থ্য সেবা ও সুরক্ষা আইন বাস্তবায়নে সেবাগ্রহীতারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে মত গবেষকদের।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, ‘আইনটা স্পষ্ট হয়নি। এটাতে প্রায়োগিক অনেক সমস্যা আছে। যারা প্রাইভেট চেম্বারে প্র্যাক্টিস করে তাদের বড় অক্ষরে জেনারিক নামে ওষুধ প্রেসক্রাইব করতে হবে। তাহলে শুধু যারা প্রাইভেট চেম্বারে প্র্যাক্টিস করছে তাদের লিখতে হবে। যারা প্রাইভেট হাসপাতালে প্র্যাক্টিস করছে তাদের লিখতে হবে না।? এই ক্ষেত্রে কি আমাদের এখানে জেনারিক নেমে লিখার সুযোগ হয়েছে? হয়নি। কারণ আমাদের সবগুলো কোম্পানির ওষুধ মানসম্মত না।’
স্বাস্থ্য সেবা ঢেলে সাজাতে প্রয়োজন বৈষম্য নিরসন। স্বাস্থ্য প্রশাসনে পরিবর্তন আনতে হবে বলে জানাচ্ছেন চিকিৎসকরা।
ইবনে সিনা মেডিকেল কলেজের কমিউনিটি মেডিসিন অ্যান্ড পাবলিক হেলথ বিভাগের অধ্যাপক ডা. খোরশেদ আলী মিয়া বলেন, ‘প্রফেশনাল একটা ক্যাডার, এটা তো নন-প্রফেশনাল দিয়ে চলতে পারে না। ম্যানেজমেন্ট সেক্টর, স্বাস্থ্য অর্থনীতি সেক্টর নিয়ে কিন্তু আসলে সম্পূর্ণ স্বাস্থ্য প্রশাসন গড়ে উঠতে পারে। তাহলে এক্সপার্ট বেসিস একটা প্রশাসন আমাদের দেশে গড়ে উঠবে।’
গবেষকরা বলছেন, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সরকারি স্বাস্থ্যসেবা–ব্যবস্থা অবহেলিত। আবার বেসরকারি খাতে চাকচিক্য থাকলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তা মানহীন ও অনিরাপদ। তাই স্বাস্থ্য সেবা ঢেলে সাজাতে দরকার হেলথ সার্ভিস কমিশন গঠন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, ‘প্রচুর সমস্যা রয়েছে। তাহলে এখানে আমাদের একটা সম্পূর্ণ পরিবর্তন লাগবে। আমাদের একটা অ্যাক্ট করতে হবে, জাতীয় স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন। এই সুরক্ষা আইনের ভেতরে অনেক কিছু থাকতে হবে। এক নম্বরে থাকতে হবে স্বাস্থ্যকে সিভিল সার্ভিস থেকে বের করে এনে বাংলাদেশ হেলথ সার্ভিস কমিশন গঠন করা।’
সর্বোপরি চিকিৎসার মান বাড়াতে বেসরকারি ক্লিনিককে উচ্চতর হাসপাতালের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক রেফারেল সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে হবে বলে মতামত বিশ্লেষকদের।