ষোলহাটি নামের গ্রামটিকে শহুরে মানুষ এই নামে এখন কমই চেনে। বরং 'উত্তরা, সেক্টর-১২' বললে সহজ হয়। গেল দুই যুগে বড়সর পট পরিবর্তন হয়েছে ঢাকার নিকটবর্তী গ্রাম ষোলহাটির। শুরুটা ১৯৯৮ সালে। শহরতলী উত্তরায় আবাসন প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ শুরু করে রাজধানী উন্নয়ন করপোরেশন (রাজউক)। ভরাট হতে থাকে আবাদি জমি, জলাধার আর ডোবা। তারপর প্লট তৈরি, জমি বিক্রি আর ইমারত নির্মাণে বিলীন হতে থাকে গ্রামীণ আবহ। ছিটেফোঁটা হিসেবে টিকে আছে এমন দু'একটি দৃশ্য।
আরেক শহরতলী কেরানীগঞ্জের শুভাঢ্যা ইউনিয়নের নাজিরবাগ। বর্তমানে পরিচিত ঝিলমিল আবাসিক নামে। ৩১১ একর জমি অধিগ্রহণ করে এই আবাসিক এলাকা প্রতিষ্ঠা করেছে রাজউক। প্রকল্পের ১ হাজার ৬৩৫ প্লট মালিকদের বুঝিয়ে দিলেও বাড়ি-ঘর তৈরি করেননি কেউ। বছরের পর বছর অযত্নে পড়ে থাকা এসব জমিতে জন্মানো আছাগা, কিছু ফলদ বৃক্ষ আর ইটের সীমানা প্রাচীর ছাড়া কিছুই চোখে পড়ে না প্রকল্পটিতে।
একসময়কার বুড়িগঙ্গা নদী ঘিরে আবর্তিত শহর ঢাকা ছুটছে আরও পূর্ব থেকে পশ্চিমে, উত্তর হতে দক্ষিণে। শহরমুখী মানুষের ঢল সামাল দিতে গ্রাম পরিণত হয়েছে নগরে। তা আরও ত্বরাণ্বিত হয়েছে আবাসন প্রকল্পের তালে। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের হিসাবে, ঢাকা ও এর আশেপাশে সরকারি প্রকল্প তিনটি আর অনুমোদিত বেসরকারি আবাসন প্রকল্প ৩৬টি। এছাড়াও নামে-বেনামে গড়ে উঠছে অনুমোদনহীন আবাসন প্রকল্প। যে কারণে ঢাকার শহরতলী ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে প্লট, ফ্ল্যাট আর প্রকল্পের ভিড়ে। রাজধানীতে যেখানে আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়নের এমন হিড়িক, তখন কি অবস্থা দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী চট্টগ্রামের?
চট্টগ্রাম শহরঘেঁষা চান্দগাঁও বিল বছর দশেক আগেও ছিল মাছ, ফল, ফসলে ভরা। এখনও যার প্রমাণ মেলে, বিলজুড়ে বিচরণ করা ভেড়া আর মহিষের পাল আর হাসের জলকেলীতে।
চাটগাঁর আবাসন চাহিদার যোগান দিতে ইতোমধ্যে অস্তিত্ব হারিয়েছে গাইস্যার বিল, বাকলিয়া বিল, রঙ্গীপাড়া, কাট্রলীসহ অন্তত সাতটি বিল। বদলে যাওয়া স্থানে বসে এখনও সুজলা-সুফলা দিনের স্মৃতিচারণ করেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
এদিকে বন্দর নগরীর আবাসন প্রকল্প অনুমোদনের দায়িত্ব চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের। ৭৭০ একরের বেশি জায়গাজুড়ে শহরতলীতে বাস্তবায়িত হয়েছে ১২ আবাসন প্রকল্প। এর মধ্যে অনন্যা ১, ২ আবাসিকে জমির পরিমাণ ১৭০ একর, সিলিমপুর আবাসিকে ৯৮ একর, আগ্রাবাদ আবাসিক এলাকায় ১৬৯ একর, চান্দগাঁওতে ১০১ একর, কর্ণফুলী আবাসিক এলাকায় ৫১ একর জায়গা রয়েছে। এই ১২ প্রকল্পে প্লটের সংখ্যা ৬ হাজার ৭৫৬টি। এসব জায়গায় কয়েক দশকে আবাসনের পরিমাণ সামান্যই।
২০০৭ সালে চট্টগ্রামের অক্সিজেন কুয়াইশ সংযোগ সড়কের পাশে ১৭০ একর জায়গাজুড়ে গড়ে ওঠা অনন্যা আবাসিকের ভেতরে চলে কৃষকের কর্মব্যস্ততা। ইটে ঘেরা কোনো কোনো প্লটে বাতাসে দোল খায় সবুজ শাক সবজি। বেগুন, শাক, ঢেঁড়স, ধান, লাউসহ নানা রকম আবাদ হয়।
একটি প্লটে শাকের আবাদ করেছেন আরেক তরুণ। জানালেন, মাসে ৪-৫ হাজার টাকার শাক বিক্রি করেন তিনি, বছর শেষে অংকের খাতায় জমা পড়ে ২৫-৩০ হাজার টাকা। এছাড়া কষ্টে-সৃষ্টে ধানও ফলান এখানে।
এক চাষি বলেন, 'আমি শাক চাষ করি। মাসে ৪-৫ হাজার টাকার শাক বিক্রি করতে পারি। বছর শেষে ২৫-৩০ হাজার টাকার আয় হয়। এখানেএ ধানও চাষ করি।'
এই কৃষকের কথা ধরে এক হিসেব কষা যাক। এই আবাসিক এলাকায় প্লটের সংখ্যা ১ হাজার ৭০০টি। সবগুলো প্লটে যদি শুধুমাত্র শাক আবাদ করা হয় তাহলে বছরে আনুমানিক ৫ কোটি টাকার শাক বিক্রি সম্ভব। একই হিসাবে সিলিমপুর আবাসিকে পাওয়া যেতো প্রায় আড়াই কোটি টাকার শাক। আর কর্ণফুলী আবাসিকে ১ কোটি ৫০ লাখ টাকার শাক-সবজি উৎপাদন হতো বছরে।
এদিকে চট্টগ্রামে রেলওয়ে, বন্দর, বিদুৎ বিভাগ, ব্যাংকসহ সরকারি কলোনীর সংখ্যা প্রায় অর্ধশত। শান্ত-নিরিবিলি এসব কলোনীতেও খালি পড়ে আছে অনেক জায়গা। প্রতিটি ভবনের সামনে পেছনে এসব জায়গায়ও অনেকে আবাদ করছেন নানা সবজি আর ফলমূলের।
দেশের বড় দুই নগরীর আবাসন অব্যবস্থাপনা তো জানা হলো। এবার জানবো আরেক বিভাগীয় শহর সিলেটের আবাসন।
সিলেট শহরের চর্তুদিকে এখন রমরমা আবাসন ব্যবসা। যে যেখানে পারছে জমি অধিগ্রহণ করে নাম দিচ্ছেন আবাসনের খাতায়। এমনকি কৃষি জমিতে সীমানা নির্ধারণ নোটিশ ব্যবহার করে ফেলে রাখা হচ্ছে বছরের পর বছর।
এই যেমন রয়েল সিটি। প্লটে প্লটে সীমানা প্রাচীর দিয়ে ফেলে রাখা হয়েছে দীর্ঘদিন। বসতবাড়ির খোঁজ করতে গিয়ে পাওয়া গেল কয়েকটি শ্যাওলা ধলা কংক্রিটের খুঁটি। অধিকাংশ জমিজুড়ে বেড়ে উঠছে জংলা গাছ। উৎপাদন হচ্ছে না কোনো খাদ্যশস্য।
কিছুদিন আগেও নিজের জমিতে ধান রোপন করতেন সিলেটের উপকণ্ঠ শাহপরান এলাকার বাসিন্দা করিম মিয়া। এখন করছেন সবজি চাষ। চারদিকের আবাসন প্রকল্পের চাপে আগের পরিবেশ আর নেই। চলছে বাসা বাড়ি তৈরি করার প্রতিযোগিতা।
কৃষি অধিদপ্তরের তথ্যে, সিলেট বিভাগে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ৭ লাখ ৬৩ হাজার ২৫৪ হেক্টর। অন্যদিকে পতিত জমি ১ লাখ ৯৬ হাজার ৩৯৯ হেক্টর। সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে এসব জমিকে চাষের আওতায় আনা গেলে উৎপাদন চিত্রই বদলের আশা অঞ্চলের কৃষি কর্মকর্তাদের।
কৃষিসম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক মোহাম্মদ খয়ের উদ্দিন মোল্লা বলেন, '৭০ হাজার হেক্টর জমিতে আমরা বোরো ২ লাখ ৮০ হাজার মেট্রিকটন চাল আমরা বাড়াইতে পারি। যদি সেচের ব্যবস্থা করে দিতে পারি।'
রাজউক অনুমোদিত ৩৬ বেসরকারি আবাসন প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণের হিসাবে দেখা যায়, আবাসন প্রকল্পে সবচেয়ে বেশি জমি বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ৩ হাজার ৩০১ একর। তারপরের স্থান জলসিঁড়ি আবাসনের ২ হাজার ১৩৩ একর। ইস্টার্ন হাউজিংয়ের বনশ্রী নিউটাউন আবাসিক প্রকল্পে ১ হাজার ৩১০ একর ছাড়াও কয়েকটি প্রকল্পে তাদের অধিগ্রহণকৃত জমির পরিমাণ প্রায় দেড় হাজার একর। এছাড়াও স্বদেশ প্রপার্টিজের আওতায় দুটি প্রকল্পে নেয়া হয়েছে ২৪২ একর জমি।
এসব আবাসনের কয়েকটিতে প্রায় শতভাগ ভবন নির্মাণ হয়েছে। তবে আফতাবনগর, গ্রিন মডেল টাউন, ইউনাইটেড সিটি, রাজউকের উত্তরা আবাসিক শহর তৃতীয় প্রকল্পের অধিকাংশ প্লটই ফাঁকা পড়ে আছে। না উঠছে ভবন, না চাষাবাদ। যেখানে মাটির হাহাকার ফোটে।
তবে উল্টো চিত্রও আছে। তা জানতে আবার ফিরতে হবে ঢাকার ষোলহাটি গ্রামে। নগরায়নের গ্রাসে গ্রামের নাম যেভাবে ভুলেছে সবাই, তেমনই ভুলেছে মাটি ও নাড়িকেও। তবে সবাই না।
ঢাকার আশেপাশে আবাসন প্লটে আবাদ করা কৃষকের সংখ্যা হাতে গোনা। কারণ, শ্রমে আর ঘামে নানান প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে ঊষর খণ্ডে ফসল ফলাতে হয় কৃষককে। এমনকি কোনো আবাসন প্রকল্পের কতটুকু জমিতে চাষাবাদ হয় সেই পরিসংখ্যানও নেই কোনো সংস্থার কাছে। কর্তাব্যক্তিদের হিসাব না থাকলেও শহরতলীতে ফলা সবজি ও ফলে আগ্রহ রয়েছে শহুরে মানুষের।
খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষা মানুষের পাঁচ মৌলিক চাহিদা। কিন্তু মৌলিক চাহিদার প্রথম শর্ত ডিঙিয়ে তৃতীয়টি অর্থাৎ বাসস্থানের উপর জোর দেয়াতে নষ্ট হচ্ছে শৃঙ্খল। ভূমি এবং কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, ১৯৭১ সালে দেশে আবাদি জমির পরিমাণ ছিল ২ কোটি ১৭ লাখ হেক্টর। যা বর্তমানে এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৮৮ লাখ ২৯ হাজার হেক্টরে।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব মতে, বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৬৯ হাজার হেক্টর আবাদি জমি অকৃষি খাতে চলে যাচ্ছে। অর্থাৎ প্রতি বছর শতকরা এক ভাগ আবাদযোগ্য জমি কমছে।
কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, 'অপরিকল্পিতভাবে কৃষিজ জমি নষ্ট করলে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া সম্ভব নয়। আমাদের এই স্বপ্ন অধরাই রয়ে যাবে।'
জনসংখ্যার অনুপাতে বিশ্বে সবচেয়ে কম ভূমি বাংলাদেশে। জনপ্রতি ৫ ডেসিমাল। সেখানে ভূমির অপচয় করে এতো আবাসন প্রকল্পের দরকার আছে কিনা এমন প্রশ্ন নগর পরিকল্পনাবিদদের।
অনুমোদনের ১০ বছরের মধ্যেই বেসরকারি আবাসন প্রকল্পের সব কাজ শেষ করার নির্দেশনা রয়েছে রাজউকের। কিন্তু যুগের পর যুগ কেটে গেলেও অধিকাংশ প্রকল্পে প্লট খালি পড়ে থাকছে। হচ্ছে না কোনো নির্মাণ। নিয়মের এমন ব্যত্যয়ে কি পরিকল্পনা রাজউকের?
রাজউক প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ আশরাফুল ইসলাম বলেন, 'পরিত্যক্ত জায়গা ফেলে না রেখে যেন সবুজায়ন বা সবজি চাষ করা হয়, সেজন্য রাজউক সবাইকে উৎসাহিত করছে। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা রয়েছে। কোনো জায়গা ফেলে রাখা যাবে না। আমরা সকল আবাসন প্রকল্ল উদ্যোক্তাকে অবগত করেছি।'