বাজেটের কথা
বাজেট ২০২৪-২৫

জাতীয় বাজেট যেভাবে তৈরি হয়

সংসার বা ব্যক্তিগত জীবন পরিচালনায় বাজেট বা আয়-ব্যয়ের হিসাব করতে হয় সবাইকে। সাধারণ মানুষকে আয়ের বিপরীতে হিসাব কষতে হয় খরচের। তবে একটি রাষ্ট্রের বাজেট এর উল্টো। রাষ্ট্রকে আগে এক বছরের জন্য তার ব্যয় নির্ধারণ করতে হয়। এর বিপরীতে কোন কোন খাত থেকে আয় করা হবে, সে বিষয়ে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। বাজেট হচ্ছে একটি দেশের সম্ভাব্য আয়-ব্যয়ের হিসাব।

অর্থাৎ সরকার আয় করে খরচ বুঝে, আর ব্যক্তি ব্যয় করেন আয় বুঝে। আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের পরিমাণ বেশি হলে রাষ্ট্র অর্থ ধার করতে পারে। ব্যক্তিও পারেন, তবে এর সীমা সামান্যই। কারণ ধার করলে নির্দিষ্ট সময়ে পরিশোধ করতে হয়। আর রাষ্ট্রকেও পরিশোধ করতে হয়, তবে এ জন্য রাষ্ট্র সাধারণত দেউলিয়া হয় না। ধার বছরের পর বছর টেনে নিয়ে যেতে পারে। এতে দায় ক্রমাগত বাড়তে থাকে।

বাজেটে সরকারি রাজস্ব ভারসাম্য হলো জাতীয় অর্থনীতির তিনটি প্রধান খাতের ভারসাম্যের একটি, অন্যটি হচ্ছে বিদেশি খাত এবং তৃতীয়টি দেশি বা বেসরকারি খাত। এই তিনটি খাতে উদ্বৃত্ত বা ঘাটতির যোগফল অবশ্যই শূন্য হওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদরা। সরকারের বাজেট ঘাটতি হয় যখন সরকার তার করের চেয়ে বেশি ব্যয় করে এবং একটি উদ্বৃত্ত ঘটে যখন একটি সরকার তার ব্যয়ের চেয়ে বেশি কর দেয়।

বলা হয়ে থাকে ১৭৩৩ সালে যুক্তরাজ্যে সর্বপ্রথম বাজেট দেওয়া হয়। আর স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বাজেট পেশ করা হয় ১৯৭২ সালে। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে মোট ৫৩ বার বাজেট পেশ করা হলেও বাৎসরিকভাবে পেশ হয়েছে ৫২ বার। কারণ ১৯৯৬-৯৭ অর্থবছরে দুবার পেশ করা হয়। একবার ছয় মাস অন্তর্বর্তী, আরেকবার মূল বাজেট।

যেভাবে তৈরি করা হয় জাতীয় বাজেট

বাংলাদেশের বাজেট প্রণয়ন করা হয় ১২ মাসের জন্য যা প্রথম বছরের ১লা জুলাই থেকে পরবর্তী বৎসরের ৩০শে জুন পর্যন্ত কার্যকর থাকে। প্রতি বছর জুন মাসে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশনে সরকারের পক্ষে অর্থমন্ত্রী বাজেট বিল পেশ করেন। এর মূল অংশ দুটি। প্রথম অংশে সরকারের রাজস্ব ব্যবস্থা ও আদায় সংক্রান্ত প্রস্তাবসমূহের বিবৃতি থাকে। দ্বিতীয় অংশে থাকে সরকারি ব্যয়ের প্রস্তাবসমূহ। প্রতি বছর একটি আইনপ্রস্তাব বা 'বিল' আকারে জাতীয় বাজেট সংসদে উত্থাপন করা হয়। যাকে বলা হয় অর্থ বিল। এর আগে এই বাজেট বিল ক্যাবিনেট সভায় বিবেচনা ও অনুমোদন করা হয়।

বাজেট কেন?

উৎপাদন, উন্নয়ন ও কল্যাণ মূলত এই তিনটি বাজেটের প্রধান লক্ষ্য। এছাড়া নানা প্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে দেওয়া বাজেটের মাধ্যমে দেশের উৎপাদন বাড়ানোর যেমন চেষ্টা থাকে, তেমনি প্রচেষ্টা থাকে উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করার। জাতীয় বাজেট সরকারের ভবিষ্যৎ আর্থিক পরিকল্পনার নথি এবং পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় আর্থিক নীতির সঙ্গে জনগণের ব্যক্তিগত পরিচালনার দলিল। যা আগামী এক বছরের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট আয়-ব্যয়ের নীতিমালা, দেশের পরিবর্তন, উন্নয়ন এবং প্রগতির ধারাকে অব্যাহত রাখতে সহজ করবে। যেখানে সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট অনুযায়ী জনগণের সেবায় সরকারের সহায়তা, বিভিন্ন অর্জনের ভিত্তিতে কিছু কর প্রস্তাব ও সংস্থাপন ব্যয়ের একটি প্রতিবেদন এবং বার্ষিক উন্নয়নের জন্য যে বরাদ্দ থাকবে তার হিসাব।

বাজেট ঘাটতি যেভাবে পূরণ করা হয়

সাধারণত দুভাবে এ ঘাটতি মেটানো হয়ে থাকে। একটি হচ্ছে বৈদেশিক উৎস এবং অপরটি অভ্যন্তরীণ উৎস। বৈদেশিক উৎস হচ্ছে বিদেশি ঋণ। সরকার বিভিন্ন বিদেশি দাতা সংস্থা ও রাষ্ট্র থেকে সহজ শর্তে ঋণ নেয়। এই উৎসের ঋণ অর্থনীতির জন্য বেশ সহনীয়। কারণ এতে সুদ হার কম, তবে পরিশোধ করতে সময় পাওয়া গেলেও শর্ত থাকে বেশি।

আর অভ্যন্তরীণ উৎস হচ্ছে দেশের ভেতর থেকে ঋণ নেয়। যা সাধারণত ব্যাংকিং ব্যবস্থা ও ব্যাংকবহির্ভূত ব্যবস্থা থেকে নেয়া হয়ে থাকে। যেখানে ব্যাংকবহির্ভূত ব্যবস্থা হচ্ছে সঞ্চয়পত্র ও সাধারণ মানুষের কাছে ট্রেজারি বিল বা বন্ড বিক্রি। এভাবে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে ঋণ নেয় সরকার।

বাজেটের অন্যান্য প্রধান বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে রাজস্ব আয়-ব্যয় এবং উন্নয়ন বাজেট। রাজস্ব ব্যয় হচ্ছে সরকার পরিচালনার খরচ। যাকে অনুন্নয়ন বাজেটও বলা হয়। এই ব্যয় মোটা দাগে তিনটি। যেমন দেশরক্ষা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও প্রশাসন চালানোর খরচ।

আর রাজস্ব আয় হচ্ছে রাষ্ট্রের আয়ের উৎস। যা তিন ধরনের হয়ে থাকে- প্রত্যক্ষ কর, পরোক্ষ কর এবং করবহির্ভূত আয়। অপরদিকে উন্নয়ন বাজেট হচ্ছে জনগণের জন্য রাস্তা নির্মাণ, সেতু নির্মাণ থেকে শুরু করে গ্রামীণ উন্নয়ন, বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি, স্কুল, কলেজ ও হাসপাতাল তৈরিসহ নানা ধরনের যে কাজ সরকার করে থাকে। উন্নয়ন বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) নামে একটি প্রকল্প খাত রয়েছে। এই খাতেই উন্নয়ন বাজেটের খরচ দেখানো হয়।

মানুষ সংসার বা ব্যক্তিগত আয়ের বিপরীতে খরচ করলেও সরকার যে খরচ করে তার বিপরীতে তার আয় এবং সম্পদ থাকে কম। সেই সঙ্গে জনগণকে দেয়া সরকারের প্রতিশ্রুতিও থাকে তার আয়ের থেকে বেশি। তাই এই আয়-ব্যয়, প্রতিশ্রুতি, উন্নয়ন এবং চলমান ধারা অব্যাহত রাখতে সুপরিকল্পিত বাজেট প্রণয়ন করাই হচ্ছে সরকারের দায়িত্ব ও কর্তব্য। তাই সরকারের খরচ এবং নাগরিকদের উন্নয়নের জন্য নেয়া নানা ধরনের উদ্যোগ বাস্তবায়নে আয় ও ব্যয়ের পরিকল্পনার নামই বাজেট।

এভিএস

এই সম্পর্কিত অন্যান্য খবর