কৃষি , গ্রামীণ কৃষি
অর্থনীতি
0

চৈত্রে ফেরে হাওড়ের আর্থিক সঙ্গতি

কিশোরগঞ্জ

শহর বন্দর তাপদাহে পুড়লেও হাওড়ে নবান্ন হয়ে আসে চৈত্র। জলাভূমির এ মাটি জেগে থাকে মাত্র আটমাস। কিন্তু সেই হাওড়ের ভাঙা-দুঃখ আনন্দ কি শুনতে পান?

দৃষ্টিজোড়া সবুজ প্রান্তর। মাটি আর জলে নতুন শীষ আসার অপেক্ষা। হাওড়ের এলেবেলে পথে জিরাতিদের যেন জিরোবারই সময় নেই। আলী হোসেন, পেশায় কৃষক। বেড়েছে তারও ব্যস্ততা।

ধানের ছন ছন শব্দ এখানে মধুর। সিদ্ধ ধানের সোনালী রং পাওয়া সুবাস। বছরের এ নবান্নে তাতে ভাত শালিকেরও দাবি আছে।

কাঠফাটা রোদে যখন শহর ক্লান্ত, তখন হাওড়ের কৃষক হাসি ফোটাতে ব্যস্ত। আনন্দ আর দু:খের দূরত্বের রং হাওয়া। স্বস্তি ফেরে আর্থিক সঙ্গতিতেও।

তপ্ত রোদ যতটা না স্বস্তির, ততটাই মেরুদণ্ড বেয়ে শীতলতা নামে হিম হাওয়ায়- এ সময় বৃষ্টি হলে খুব ক্ষতি হয়ে যাবে- বলছিলেন কৃষকরা।

একজন হাওড় চাষি বলেন, 'বৃষ্টি আর রোদ মিলাইয়া হইলে আমাদের জন্য খুব ভালো। আর যদি শিলাবৃষ্টি-বাতাস হয় তাইলে আমাদের জন্য গজব।'

ভাতের মাড় আর ধানের খড়ে যাদের বৈশাখ-আশ্বিনের দিনপাত, তারাও এ সময় কিছুটা সবুজ ঘাস-কুটোর স্বাদ পায়। রমজানের পরই কুরবানির ঈদ, জলের জোয়ারে মাছ মারার সময়ে ঘরের পশুটিকে যত্নআত্তির সুযোগ পান কৃষক।

কিছুই ফেলনা না এখানকার জমির। প্রাণ প্রকৃতি সবার ভাগ বুঝিয়ে দিতে আসে চৈত্র। হাওড়ের শেষ সময়ে যা ফলে তার শেষ দানাটুকুও পরের মৌসুমের জন্য ঈশ্বরের আশীর্বাদ। তাই ৩০ হাজার জিরাতির ঘরকন্নারাও ফসলের সাক্ষী।

মৌসুমের প্রায় শেষের দিকে ভাগের দেনা পাওনার একটি হিসাব আছে। সেখানে আলী হোসেনরা ভাগের খাতা কখনও কখনও শূন্যতা নিয়ে শুরু করেন।

অভিযোগ তুলে কৃষকরা বলেন, 'সরকার থেকে বীজ-সারসহ যে সহযোগিতা আসে, আমরা তাই পাই না। তারা আগেই সব বিক্রি করে দেয়। আমরা নিজের টাকা দিয়ে চাষ করি।'

কাদা, মাটি ও জল মিলে চলা বলয়ে এ চৈত্রের দেনা পাওনা হিসাবের পর হয়তো কৃষকের ঘরে আলো আসবে। ঘরের চালে নতুন ছন লাগবে, কারওবা বিয়ের আসর বসতে বাকি। ব্যস্ত হবে কোন ব্যান্ড পার্টি, তার জন্য চাই রৌদ্রোজ্জ্বল দিন আর জলমাটির বন্ধন।

হাওয়ার সঙ্গে বদলে যায় জলের কিনারার ঢেউ। নদী আর শাখা হারায় তার নিয়ন্ত্রণ আর প্রকৃতি। সে সময় জলের কিনারে ছপ ছপ শব্দ বন্ধ থাকলেও চলে আশার মেরামত। জোয়ার ভাটার এ গণিতে আছে দুর্বল আর শ্রেণী বৈষম্যের গল্প। নুরুলদীন হীন সে গল্পে হঠাৎ আক্রমণ করা জলদস্যু আর লণ্ডভণ্ড হয় জনপদ। কেউ নেই বলবার- জাগো বাহে কোনঠে সবায়?

এক জেলে জানান, তারা কিছু জায়গা সরকার থেকে ইজারা পান। তারপর পুরো হাওড়ের জেলেদের তারা আটক করে ফেলে। মাছ ধরলেও ৩০০ টাকার মাছ ধরলে তাদের খাজনা দিতে হয় ২৫০ টাকা।

যাদের কোন উপায় নেই তারা শহর ছাড়েন। আর ফেরা হয় না। যেটি কম তা হলো উৎপাদনের নতুন হাওয়া আর ফলনের বিচিত্রতা। যা হাওড়ের মানুষকে ফেরাতে পারে নিজের ঘরে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, 'হাওড়ে যা প্রয়োজনীয়, কৃষি চরে সেটা নাও হতে পারে। আবার চরের কৃষির যা প্রয়োজন দক্ষিণ বাংলায় তা নাও হতে পারে। সুতরাং একেকটা এলাকার কৃষির বৈশিষ্ট্য মাথায় রেখে আমাদের কাজ করতে হবে। হাওড়ের কৃষিতে সবচেয়ে দরকার সংরক্ষণ।'

তবে এতসব বোঝেন না এখানকার কৃষকরা। সাইদুর রহমান, মেজানুদ্দীনরা বলতে বলতে খেই হারান। কী প্রয়োজন তা ভুলে যান অধিকারবোধ শূন্যতায়।

অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম জাহান বলেন, 'নীতিমালাগুলোকে বিভাজন করতে হবে। কৃষক-জেলেদের চাহিদা অনুযায়ী নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে এবং বাস্তবায়ন করতে হবে। কারণ মাঠ পর্যায়ের বাস্তবতা একেবারে ভিন্ন। নীতিনির্ধারকদের এ বাস্তবতা মাথায় রাখতে হবে।'

শেষ বেলায় জিরাতিরা ঘরে ফেরেন। আরেকটি দিনের অপেক্ষা। দিন ঠিক করবে দেশের মানুষের পেটের রাক্ষুসে ক্ষুধার দর আর ভবিষ্যৎ কী!

এভিএস

এই সম্পর্কিত অন্যান্য খবর