'ওর আব্বু অসুস্থ। আমাদের এক মেয়ে বিয়ে দিয়েছি আরেক ছেলেকে দাখিল মাদ্রাসায় ভর্তি করেছি। সংসারে কাজ করে খাওয়ার মতো তো কেউ নেই।’ কথাগুলো বলছিলেন সুরাইয়া আক্তার।
লাখ টাকার স্বপ্ন সুরাইয়া আক্তারের কাছে আকাশ কুসুম ব্যাপার। প্রাথমিকে পড়ুয়া ছোট ছেলেকে চেয়েছিলেন উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করাতে। তাই মাসিক ৯০ টাকা কিস্তিতে শিশু বীমা করেছিলের প্রতিবেশীর পরামর্শে। ছেলে মাধ্যমিকের গণ্ডি পার হয়েছে। পরিশোধ হয়েছে ১০৮ টি কিস্তি। জমা পড়েছে ৯৭২০ টাকা। পলিসির মেয়াদ ২ বছর আগে শেষ হলেও দেখা নেই টাকার।
তিনি বলেন, 'দুই ছেলে মেয়েকে নিয়ে হেটে ভাবির কাছে গিয়েছি। ভাবি বলেছে যদি আল্লাহ দেয়, তাহলে টাকা পাবা নাহলে তো আর কিছু করার নেই।'
একই অবস্থা কুমিল্লার গোপাল নগর এলাকার গৃহবধূ পারুল বেগমের।
তিনি বলেন, 'আমাদের স্বপ্ন দেখিয়ে ভর্তি করিয়েছে। একটা টেনশন থাকতো টাকা জমা দেওয়ার। ডিম, কুড়া বিক্রি করে টাকা জমা দিয়েছি।'
মানুষগুলোর কাছে এখন যেন ধোঁকার অপর নাম বীমা। কিভাবে এ ফাঁদে পা দিয়েছিলেন তারা?
ভুক্তভোগীদের একজন বলেন, '২০০ টাকা জোগাড় করতে পারিনা। এরপরে মাথার চুল, পুরনো কাপড় বিক্রি করে জমার টাকা জোগাড় করেছি।'
আরেকজন বলেন, 'মাসে ২০০ টাকা করে জমা করলে তাদেরকে ৪৫ হাজার টাকা দেওয়া হবে। আর যারা ২৯০০ টাকা জমা করবে তাদেরকে ১ লাখ টাকা দেওয়া হবে। যারা ৬ হাজার টাকা করে জমা করবে তাদেরকে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা দেওয়া হবে।'
জানা গেল বিমাকারী প্রতিষ্ঠান সান লাইফ ইন্সুরেন্স। কেন পাচ্ছে না টাকা, সে বিষয়ে খোঁজ নিতে যেতে হবে কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়ায়। জানা গেছে, সেখানে সানলাইন ইন্সুরেন্সের অফিস দীর্ঘদিন পর্যন্ত বন্ধ পড়ে আছে। আপাতত একজন কর্মী আছেন সেখানে।
ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে ওই কর্মচারী বলেন, 'আমি কোম্পানির এ অফিসের রের্কডকিপার ছিলাম। আমাদের বেতন দেয় না দেখে আমরা আসি না। অনেক আত্মীয়স্বজনকে বিমা করিয়েছি, তারা মাঝে মধ্যে ফোন করে বলে আমার বইগুলো জমা দিয়ে দিতে।'
ভুক্তভোগী আরেকজন বলেন, 'প্রায় ১৬-১৭ টা বই ছিল। সবগুলোর মেয়াদ শেষ। এর আগে আমি ৪টা বই জমা দিয়েছি। ওই বইগুলোর কোনো খোঁজ নেই দুই-আড়াই বছর হয়ে গেছে।'
জানা গেল, এই অফিসটি দীর্ঘদিন বন্ধ রয়েছে। ঢাকার সান লাইফ ইন্সুরেন্সের প্রধান কার্যালয়ে গিয়ে দেখা গেল পুরনো ব্যবস্থা। কথা বলতে চাইলে জানানো হলো, সময় নিয়ে পরবর্তী কোনো দিন যোগাযোগ করতে হবে।
এই অফিসে চাঁদপুরের আরেক ব্যক্তিকে পাওয়া গেল। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, 'কষ্ট করে এতবছর টাকা জমা দিয়েছি। এখন কোনো কূল কিনারা খুঁজে পাচ্ছি না। কী করব?'
এসব সমস্যা দ্রুত সমাধানের পথ নেই বীমা নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কাছে।
বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ নির্বাহী পরিচালক ড. নাজনীন কাউসার চৌধুরী বলেন, 'কোনো এজেন্ট বা ভুয়া এজেন্ট গ্রাহক হয়রানি করতে পারবে না। এখন এই সমস্যাগুলো তো আছেই। এজন্যই আমরা সিস্টেমগুলো ডেভেলপ করছি। যার ফলে গ্রাহক হয়রানি বন্ধ হবে।'
২০১৮ জিডিপিতে বীমা খাতের অবদান ছিল দশমিক ৫৫ শতাংশ, ২০১৯ সালে দশমিক ৫৩, ২০২০ সালে দশমিক ৪২, ২০২১ সালে দশমিক ৪১ ও ২০২২ সালে দশমিক ৪০। আর সর্বশেষ ২০২৩ সালের হিসাব এখনও করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ।
নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (এনএসইউ) অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স বিভাগের চেয়ারম্যান মো. নুরুল কবীর বলেন, 'অভিযোগগুলো সুষ্ঠুভাবে তদন্ত করে বীমার যে সমস্ত কোম্পানি এ কাজের সঙ্গে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে পর্যাপ্ত আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। তাহলে সবাই সর্তক হয়ে যাবে।'
বীমা শিল্পে ৫০ বছরেও মুখ ফুটে অবদান রাখতে পারছে না জিডিপিতে। যদিও দেশে বর্তমানে ৮৫টি বীমা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে।