২০২৩ সালে ঋণ পেতে রাজস্ব সংস্কার, মূল্যস্ফীতি ও আর্থিক খাতসহ সামষ্টিক কাঠামো সংস্কারের শর্ত দেয় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)।
এরপর ব্যাংক ও আর্থিক খাতে শর্ত অনুযায়ী সংস্কারের উদ্যোগ নেয় সরকার। সে সময় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে কয়েকদফায় নীতি সুদ হার বাড়িয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। নয় ছয়ের সীমা থেকে বেরিয়ে বাজারভিত্তিক সুদের হার চালু হয়েছে।
আইএমএফের শর্তের মধ্যে মুদ্রা ও বিনিময় হারের সংস্কার, আর্থিক খাত ও রাজস্ব সংস্কার এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বেশ এগিয়েছে বাংলাদেশ। যা যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ করপোরেশনের (এমসিসি) গবেষণায় উঠে এসেছে। এমসিসি’র প্রতিবেদনে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ২০টি সূচকের মধ্যে ১৭টিতেই ঝুঁকিতে বাংলাদেশ। তবে মুদ্রাস্ফীতি, রাজস্ব নীতি ও টিকা দেয়ার হার—শুধু এ তিন সূচকে রয়েছে সবুজ জোনে।
তবুও লাগাম টানা যায়নি মুদ্রাস্ফীতির। ডিসেম্বরের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, যার হার ৯ দশমিক চার এক শতাংশ। মুদ্রাস্ফীতি ৬ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনতে তাই আরও সংকোচনমুলক মুদ্রানীতির পথে হেঁটেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, যেখানে নীতি সুদহার ২৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৮ শতাংশ করা হয়েছে। লক্ষ্য ঋণের চাহিদা কমানো ও অর্থনীতিতে অর্থের প্রবাহ কমানো। তবে মুদ্রানীতির এই অবস্থানকে খুব একটা ইতিবাচকভাবে দেখছেন না ব্যবসায়ীরা।
বাংলাদেশের মুদ্রাস্ফীতি, রাজস্ব নীতি ও টিকা দেওয়ার হার
বিকেএমইএ'র নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, 'মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য সুদের হার বাড়িয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত ব্যবসায়ী হিসেবে আমার সঠিক মনে হচ্ছে না। যদি সুদের হার বেড়ে যায় তাহলে যে ব্যবসায়ী ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বিদেশ থেকে যে পণ্য আমদানি করবে। সবশেষে বর্ধিত মূল্যটা সেই পণ্যের ওপর পড়বে। তাহলে তো মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যাবে। আর বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ কমানোতে ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।'
চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি মো. ওমর হাজ্জাজ বলেন, 'সুদের হার বেড়ে যাওয়ার কারণে ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে আমাদের কিছুটা সমস্যা হবে। তবে আমাদের দক্ষতা কাজে লাগিয়ে এটা পার করে আসতে হবে।'
আগামী জুন শেষে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি ১১ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। অন্যদিকে সুদ হার করিডোরের নিম্নসীমা রিভার্স রেপো বা স্ট্যান্ডিং ডিপোজিট ফ্যাসিলিটির সুদহার ৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৬ শতাংশ করা হয়েছে। এ অবস্থায় পুঁজিবাজারে ঘোষিত মূদ্রানীতির কোনো প্রভাব পড়বে না বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
পুঁজিবাজার বিশ্লেষক আহমেদ রশিদ আলী বলেন, 'টাকাটা পুঁজিবাজার থেকে বের হয়ে ফিক্সড ডিপোজিট, বন্ড অথবা ট্রেজারি বিলে যাবে। এগুলোর সুদের হার তো ইতোমধ্যেই অনেক বেশি। এই পলিসির প্রেক্ষিতে কোন প্রভাব পুঁজিবাজার এবং বাজারে পড়বে না।'
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, 'সুদের হার বাড়লে শেয়ারবাজারের ওপর বিরুপ প্রভাব পড়ে। কারণ শেয়ারবাজার থেকে টাকা বাজারে চলে যায়। বাংলাদেশে মুদ্রানীতি দিয়ে মুদ্রাস্ফীতি অর্জন করা কঠিন। কারণ এখানে মুদ্রাহীন বিষয়গুলোই বেশি সচল।'
মূল্যস্ফীতির জন্য চাহিদা ও সরবরাহ দুটিই যেমন দায়ী তেমন মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাজস্ব নীতির সমন্বয়ও জরুরি। কাজেই শুধু মুদ্রানীতির মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি পুরোটা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে এমন আশা করা নিতান্ত অমূলক। তাই মুদ্রানীতি, মূল্যস্ফীতি, রাজস্ব নীতি কিংবা সামগ্রিক আর্থিক খাতে ইতোমধ্যে সরকার যে পদক্ষেপ নিয়েছে, তা টেকসই করতে পারলেই বাজার অর্থনীতিসহ এর সুফল মিলবে সামগ্রিক অর্থনীতিতে।