প্রতিনিধি বাছাইয়ের একধরনের পদ্ধতি নির্বাচন। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বর্তমানে গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে শাসনকাজে অংশ নেন সাধারণ জনগণ। আর তাই গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অংশ নির্বাচন। আধুনিক সমাজে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য প্রতিনিধি নির্বাচন করতে এই পদ্ধতির চল থাকলেও ইতিহাসে দেখা যায়, আদিম জনগোষ্ঠীর মাঝেও কোন না কোনো নির্বাচনী ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। সেই আদিম পদ্ধতিই এখন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কাঠামো নির্ধারণ করছে। নির্বাচনের ইতিহাস ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নির্বাচনী পদ্ধতি জানবো আজ।
অতি প্রাচীন কাল থেকেই হয়ে আসছে নির্বাচন
ইতিহাসবিদদের মতে প্রাচীন গ্রীস ও রোমে ৪০৮ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ থেকে নির্বাচন ব্যবস্থা প্রচলিত। সেসময় গ্রীসের শাসন পদ্ধতিতে লটারির মাধ্যমে নির্বাচন প্রচলিত ছিল। আমেরিকার আদিবাসীরা একটি পাত্রে যেকোনো ধরনের ফসল ঢিল ছোঁড়ার মাধ্যমে নির্ধারণ করতো গোত্রপ্রধান।
নির্বাচনের মাধ্যমে বাছাই হতো শাসক পোপ
প্রাচীন ভারতে স্থানীয় প্রধান নির্বাচন করতেন জনগণ। রাজাদেরও বাছাই করতে পারতেন প্রজারা। রোমান সম্রাট ও শাসক পোপ নির্বাচনের ক্ষেত্রেও নির্বাচন পদ্ধতি ব্যবহার হতো। বাংলার গ্রামে গ্রামে পঞ্চায়েতপ্রধান বা গ্রামপ্রধান, পাটোয়ারী বা কর আদায়কারি নির্বাচিত হতো এই পদ্ধতিতে।
তবে বর্তমানে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য আধুনিক যে নির্বাচন ব্যবস্থা তার শুরু হয়েছিল ত্রয়োদশ শতকে। তখন ইংল্যান্ডে গড়ে ওঠেছিল সংসদীয় ব্যবস্থা। তবে প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র ও সরকার গঠনের ধারণা আসে সপ্তদশ শতাব্দীর শুরুর দিকে। ধীরে ধীরে নির্বাচনী আইন প্রণয়ণের মাধ্যমে পুরো বিশ্বে এই প্রক্রিয়া আরও অনেক বেশি গ্রহণযোগ্যতা পায়। ১৮৭২ সালে গোপন ব্যালট পদ্ধতি প্রবর্তিত হয় এবং ১৯২৮ সালে সর্বজনীন ভোটাধিকারের বিধান চালু হয়।
১৯২৮ সালের আগে সব দেশে নারীদের ভোটের অধিকার ছিল না
তবে ১৯২৮ সালের আগে সমাজের সব শ্রেণির মানুষের ভোটাধিকার ছিল না। উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলোতে পুরুষরাই প্রাধান্য পেতেন নির্বাচন প্রক্রিয়ায়। একই ধারা বেশিরভাগ দেশেই ছিল। আবার অনেক জায়গায় ভোটার হিসেবে জমিদার অথবা শাসক শ্রেণির পুরুষরা প্রাধান্য পেতো।
১৯২০ সাল পযর্ন্ত চিত্রটা অনেকটা এমনই ছিল। এরপর থেকে বিভিন্ন দেশে নারীদের ভোটার হিসেবে ভাবা শুরু হয়। তবে, ১৮৯৩ সালেই নিউজিল্যান্ডের নারীরা ভোটের অধিকার পেয়েছিলেন। যদিও তখন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারতেন না তারা। ১৯১৮ সালে ব্রিটেন ও ১৯২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নারীরা ভোটের অধিকার পান।
চলুন এবারে জেনে আসি বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোতে কীভাবে নির্বাচন হয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
প্রায় দুইশ শতাব্দী ধরে নির্বাচনে গণতন্ত্র চর্চা করে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। প্রতি চার বছর পর পর এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও বিশ্বের অন্যান্য গণতান্ত্রিক নির্বাচন থেকে কিছুটা জটিল এই নির্বাচন।
বেশ কয়েকটি ধাপে অনুষ্ঠিত হয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এরজন্য অবশ্য সবার আগে দলে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করতে হয় প্রার্থীকে। দলের জাতীয় সম্মেলনে চূড়ান্তভাবে প্রার্থীকে মনোনয়ন দেয়া হয়। এরপর রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়। যার মাধ্যমে প্রার্থীর যোগ্যতা, বিচক্ষণতা ও জ্ঞানের পরিধি বোঝা যায়। এরপর মূল নির্বাচনে কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদ, উচ্চকক্ষ সিনেটের এক তৃতীয়াংশ এবং ইলেক্টোরাল কলেজের সদস্যরা নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে ইলেক্টোরাল কলেজের সদস্যরা নির্বাচিত করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।
এই প্রক্রিয়াটি অনেকটা পরোক্ষ। প্রথমে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হয় সিনেটের ১০০ সদস্য ও প্রতিনিধি পরিষদের ৪৩৫ জন সদস্য। ওয়াশিংটন ডিসি থেকে নির্বাচিত আরও ৩ জন নিয়ে মোট ৫৩৮ জনের সমান ইলেক্টোরাল কলেজের সদস্য নির্বাচন করা হয়। আর নির্বাচনের আগেই এসব প্রার্থী নিজের ও দলের পছন্দ অনুযায়ী ইলেক্টর মনোনয়ন দেন। মেইন ও নেবরাস্কা অঙ্গরাজ্য ছাড়া বাকিগুলোতে যে প্রার্থী যত বেশি জনগণের ভোট পাবেন সে রাজ্যে তার মনোনীত সব ইলেক্টর জয়ী হবেন।
কোনো প্রার্থীকে জয়ী হতে হলে ২৭০ টি ইলেক্টোরাল ভোট পেতে হয়। আর কোনো প্রার্থীই যদি এটি না পায় তাহলে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দায়িত্ব চলে যায় কংগ্রেসের হাতে। তখন নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদে ভোটের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
দেশটির বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী, একজন দুই মেয়াদের বেশি প্রেসিডেন্ট পদে থাকতে পারবে না।
যুক্তরাজ্য
ব্রিটিশ পার্লামেন্ট দুইকক্ষ বিশিষ্ট। উচ্চ পরিষদের নাম ‘হাউজ অব লর্ডস’ আর নিম্ন পরিষদ ‘হাউজ অব কমনস্’।
নিম্ন পরিষদই ব্রিটিশ জনগণের ভাগ্য নির্ধারণ করে। বাংলাদেশের সংসদ নির্বাচনের মতোই হাউজ অব কমনস্ এর ৬৫০ জন প্রতিনিধি নির্বাচিত হয় জনগণের সরাসরি ভোটের মাধ্যমে। কোনো দল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে সরকার গঠন করে। তবে এটি না পেলে ওই দলই জোট সরকার গঠন করে।
রাশিয়া
রাশিয়ার সংবিধান অনুযায়ী ২০০৮ সাল পর্যন্ত প্রতি চার বছর পর পর জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের বিধান ছিল। তবে এরপর এ পদ্ধতির পরিবর্তন আনা হয়। ২০১২ সাল থেকে প্রতি ছয় বছর পর পর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
দেশটিতে কখনো কখনো দুই ধাপে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয়। প্রেসিডেন্ট হতে হলে কোনো প্রার্থীকে প্রথমেই নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে হবে। তবে সেটি না হলে প্রথম ও দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভোট পাওয়া দুই প্রার্থীর মধ্যে ভোট অনুষ্ঠিত হয়।
ভারত
প্রতিবেশী দেশ ভারতের নির্বাচন অনেকটা যুক্তরাষ্ট্রের আঙ্গিকে হয়ে থাকে। বিভিন্ন রাজ্য ও কেন্দ্রে আছে আলাদা আলাদা আইনসভা। কেন্দ্রের আইনসভাকে বলে সংসদ। দুইকক্ষবিশিষ্ট ভারতের সংসদ-লোকসভা ও রাজ্যসভা। জনগণের সরাসরি ভোটে লোকসভার ৫৪৩ টি আসনে প্রতিনিধি নির্বাচিত হন। আর রাজ্যসভার ২৪৫ সদস্যের মধ্যে ২৩৩ জন নির্বাচিত করেন আইনসভার সদস্যরা। সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে নির্বাচিত হন বাকি ১২ সদস্য।
প্রতি পাঁচ বছর পর পর দেশটিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
পাকিস্তান
দুইকক্ষবিশিষ্ট পাকিস্তানের জাতীয় সংসদের উচ্চকক্ষের নাম সিনেট আর নিম্নকক্ষ ‘মজলিস-ই-শূরা’। নিম্নকক্ষের আসন ৩৪২টি। এরমধ্যে ২৭২ টি আসনে সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়। আর বাকি আসনগুলোর মধ্যে ৬০ টি নারী ও উপজাতিদের জন্য ১০ টি আসনের প্রতিনিধি নির্বাচন পদ্ধতি একটু ভিন্ন। দল যে পরিমাণ ভোট পায় সেই অনুপাতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তাদের নির্দিষ্ট আসন বরাদ্দ করেন।
বাংলাদেশের নির্বাচনে আট ঘণ্টা ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হলেও পাকিস্তানে ভোট দেওয়ার সময় দশ ঘণ্টা। সকাল ৮ টায় শুরু হয়ে শেষ হয় সন্ধ্যা ৬ টায়।
সব দেশের আইনে ভোট দেওয়ার জন্য একটি নির্দিষ্ট বয়সসীমার প্রয়োজন হয়। যেমন বাংলাদেশে ১৮ বছর ও তার বেশি বয়সী নাগরিকরা ভোট দিতে পারেন। গণতন্ত্রে বর্তমানে বেশিরভাগ শ্রেণি ভোট দিলেও একসময় তা ছিল না। উনিশ শতকের আগে নারীরা ভোট দিতে পারতো না। আবার অনেক জায়গায় ক্রীতদাসরাও ভোট দিতে পারে নি।