কম বয়সেই বাড়ছে হৃদরোগ ঝুঁকি, প্রতি চার রোগীর একজনই তরুণ

শিক্ষার্থী ভাজাপোড়া খাচ্ছেন ও ফার্মেসির দোকান
শিক্ষার্থী ভাজাপোড়া খাচ্ছেন ও ফার্মেসির দোকান | ছবি: এখন টিভি
1

দিন দিনই নীরব ঘাতক হয়ে উঠছে ডায়াবেটিস, ক্যান্সার, হৃদরোগ, মানসিক সমস্যাসহ নানা অসংক্রামক রোগ। গবেষণায় উঠে এসেছে বাংলাদেশে ৭১ শতাংশ মৃত্যু হচ্ছে এসব অসংক্রামক রোগে, যেখানে বেশিরভাগই অল্পবয়সী। চিকিৎসকরা বলছেন, বর্তমানে হার্টের সমস্যা নিয়ে কমবয়সী রোগী পাচ্ছেন প্রতি চারজনে একজন, যাদের অধিকাংশের বয়স ৩০ এর মধ্যে।

ক্লাসের শুরুর বাকি আছে মাত্র দশ মিনিট। ঘুম থেকে উঠে তাই সকালে তড়িঘড়ি করে কোনভাবে ব্যাগ গুছিয়েই দৌড় মাস্টার্স পড়ুয়া মেহেদী।

ক্লাস যখন শেষ হলো তখন সকাল গড়িয়ে দুপুর। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রায় প্রতিদিনের সকালই শুরু হয় এভাবে নাস্তা ছাড়াই। এরপর সকাল আর দুপুর মিলিয়ে যে খাওয়াটা পেটে পড়ে সেটাও বাইরের ভাজাপোড়া বা রুটি কলা। ফলে গ্যাস্ট্রিক, মাথা ব্যথা, ঘুম না হওয়া আর শরীর দুর্বলতা তার নিত্যসঙ্গী।

শিক্ষার্থীদের একজন বলেন, ‘সকালে ক্লাস থাকে। সকালে তেমন খাবার পাওয়া যায় না। দুপুরে বাহিরে খাচ্ছি এভাবেই চলছে আমার সার্কেল।’

এরপর দেখা মিললো রিকশাচালক গফুর মিয়ার। ভোরবেলা কাজের তাগিদে বের হলেও খরচ বাঁচাতে বসে পড়েন রাস্তার পাশের দোকানেই। যেখানে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের সাথে খাবারে ধুলোবালি ফ্রিতে পাওয়া যায়।

রিকশাচালক গফুর মিয়া বলেন, ‘যে টাকা ইনকাম করি সেই টাকা দিয়ে চলে না। তারপরও যে টাকা ইনকাম করি তা আমার সংসারে পাঠাতে হয়।’

দিনমজুর, শিক্ষার্থী বা চাকরিজীবী বর্তমানে সবাই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসে ফলে বার্ধক্যের আগেই অল্প বয়সেই শরীরে বাসা বাঁধছে ডায়াবেটিস, ক্যান্সার, বাড়ছে উচ্চরক্তচাপ, হৃদরোগ, মানসিক সমস্যা, শ্বাসকষ্টসহ নানা অসংক্রামক রোগ।

আরও পড়ুন:

ফার্মেসির দোকানগুলোতে গিয়ে দেখা গেলো আগের চেয়ে কয়েকগুণ বেড়েছে এসব রোগের ওষুধের বিক্রি। গ্যাস্ট্রোলিভার থেকে শুরু করে কিডনি রোগের ওষুধের বিক্রি বেশি বলে জানান বিক্রেতারা।

ফার্মেসির কর্মচারীরা জানান, আগে আমাদের গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ বেশি বিক্রি হতো। এখন লিভারের ওষুধও বিক্রি হচ্ছে। পাশাপাশি হাই প্রেশার আর ডাইবেটিক্সের রোগী প্রতিদিনই আসছে।

স্ট্রোক, লিভার এবং কিডনিজনিত সমস্যা এখন আর শুধু বয়সের রোগ নয়। চিকিৎসকরা বলছেন, বর্তমানে হার্টের সমস্যা নিয়ে কমবয়সী রোগী পাচ্ছেন প্রতি ৪ জনে একজন, যাদের অধিকাংশের বয়স ৩০ এর মধ্যে। অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, ধূমপান, তামাক সেবন আর অনিয়মিত জীবনযাপনই এর প্রধান কারণ তাই নজর রাখতে হবে খাদ্যাভ্যাসে এবং শরীরচর্চায়।

হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. চয়ন সিংহ বলেন, ‘হাসপাতালে প্রতি তিন থেকে চারজনের মধ্যেই দেখা যাচ্ছে একজনের বয়স ৩০ এর নিচে। এটি আমাদের দেশের জন্য খুবই অ্যালার্মিং। অসাস্ব্যকর জীবন-যাপন আর ট্রিটমেন্ট নিতেও ইয়াং জেনারেশনরা ডিলে করে। ফলে মৃত্যুর হারও বেশি দেখা যায়।’

পুষ্টিবিদ শামিনা জামান কাজোরি বলেন, ‘৭ ঘণ্টা ঘুম ম্যান্ডাটরি। খাদ্যাভ্যাসের টাইম ঠিক করতে হবে। যতটা পারা যায় বাসায় তৈরি খাবার খাওয়ার চেষ্টা করতে হবে।’

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণায় দেখা গেছে বাংলাদেশে ৭১ শতাংশ মৃত্যুই হচ্ছে অসংক্রামক রোগের কারণে যার মধ্যে ৩৪ শতাংশ হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসজনিত মৃত্যু। এছাড়া এনসিডি স্টেপস সার্ভে ২০২২ অনুযায়ী ৩৭ শতাংশ মানুষ খাবারের সঙ্গে লবণ গ্রহণ করে এবং ১৩ শতাংশ মানুষ মাত্রাতিরিক্ত লবণযুক্ত ফাস্ট ফুড খেয়ে থাকে যা রক্তসঞ্চালন প্রক্রিয়া ও স্নায়ুতন্ত্রের উপর চাপ ফেলে বাড়াচ্ছে মৃত্যুঝুঁকি।

স্বাস্থ্য গবেষকরা বলছেন, স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতনতা বাড়ছে না। তাই স্বাস্থ্যের প্রতি যত্নশীল হওয়ার পাশাপাশি দরকার নিরাপদ খাদ্যের বিধিমালাসহ আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন।

স্বাস্থ্য গবেষক প্রফেসর ডা. সোহেল রেজা চৌধুরি বলেন, ‘পারিবারিক যে পরিবেশ গড়ে ওঠে সেটি পরিবর্তন করা কঠিন। ব্যক্তিগতভাবে সচেতন হবেন। প্রসেস ফুড যেগুলো আছে সেগুলোর মধ্যে যেন লবণ কম দেয়া হয় এমন আইন করতে হবে।’

অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণে সরকার দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে অল্প বয়সে মৃত্যুর হার বাড়বে। কমবে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা। যা ভবিষ্যতে দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মত বিশেষজ্ঞদের।

এফএস