উত্তর সিটি করপোরেশনের উন্নত সেবা কেবল স্বপ্ন!

দেশে এখন
বিশেষ প্রতিবেদন
0

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের নতুন ১৮টি ওয়ার্ডে সিটি করপোরেশনের দৃশ্যমান নাগরিক সেবা নেই। তবে পুরনো ৩৬টি ওয়ার্ডও যে সেবাদানে এগিয়ে তাও নয়। নাগরিক সেবা পেতে পদে পদে এখনও ভোগান্তি আর হয়রানি। তবে উত্তর সিটি করপোরেশনের দাবি, লোকবল সংকট থাকলেও সেবার মান তাদের কমেনি। আর নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, উন্নত সেবা দিতে হলে সিটি করপোরেশনের মানসিকতায় পরিবর্তন আনা দরকার।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের নতুন ওয়ার্ডের একটি সড়কে খানাখন্দের কারণে মাঝে মধ্যেই রিকশা-ভ্যান উল্টে যায়। কাগজে কলমে এটি ডিএনসিসির ৫২ নম্বর ওয়ার্ড। তবে সুযোগ সুবিধা আর সেবার দিক থেকে এটি গ্রামের ইউনিয়ন পরিষদকেও হার মানায়।

২০১৬ সালে ঢাকা উত্তর সিটির সঙ্গে যুক্ত হয় নতুন ১৮টি ওয়ার্ড। তবে এখনও এসব ওয়ার্ডে নেই সিটি করপোরেশনের দৃশ্যমান নাগরিক সেবা।

এতো গেল নতুন ওয়ার্ডগুলোর কথা। তবে সেবার দিক থেকে পুরনো ৩৬টি ওয়ার্ডও খুব একটা এগিয়ে নেই। এখানেও ভোগান্তি আর হয়রানি পদে পদে।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ২১ নং ওয়ার্ডে চলছে নাগরিক সেবা দেয়ার কাজ। তবে মান নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করলেন এক নারী।

তিনি বলেন, 'এখানে যে আছে, তিনি বলতেছে, অনেকজনের কাজ একা করেন। উনি এখানে নেই। এখন আমি কার থেকে সিগনেচার করাবো? রোববারে তাখি থাকলেও করে দিচ্ছে না।'

সাবরীনা আক্তার। বয়স্ক এই নারীও সেবা নিতে এসে বিরক্ত।

তিনি বলেন, 'বললাম আমি অসুস্থ, আমাকে বললো ওই পাশে গিয়ে বসেন। আমি আর কোথায় বসবো জায়গা নেই। তো এসে ফ্যানের নিচে দাঁড়াইলাম। কিন্তু দাঁড়াতেই পারছি না, মনে হচ্ছে আবার স্ট্রোক করবো। আমি কিন্তু ব্রেন স্ট্রোকের রোগী।'

গত ২৬ সেপ্টেম্বর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সব কাউন্সিলরকে অপসারণ করা হয়। এরপর নাগরিক সনদ, ওয়ারিশন সনদ, চারিত্রিক সনদ, অবিবাহিত সনদ, প্রত্যয়নপত্র, পারিবারিক সনদসহ অন্যান্য সনদ পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয় সংশ্লিষ্ট আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তাকে। যার বেশিরভাগ কাজ হয়ে থাকে বিভিন্ন ওয়ার্ড অফিসে। যদিও সেবার মানে কোনো পরিবর্তন নেই।

স্থানীয় একজন বলেন, 'অনেকগুলো কাগজ লাগে। এই কাগজগুলো জোগাড় করতে অনেক হয়রানি হতে হয়। আর সেই হয়রানির কাণে অনেক দীর্ঘ সময় চলে যায়। যেমন আমি আজকে ছয়দিন হলে এখানে ঘুরতেছি একটা জন্মনিবন্ধন নেয়ার জন্য। এখনও হাতে পাইনি।'

অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ, জলাবদ্ধতা নিরসন, বর্জ্য অপসারণ এবং রাস্তা পরিষ্কার, রাস্তা-ঘাট, ফুটপাত ও ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ, রাস্তার বৈদ্যুতিক লাইট স্থাপন, পার্ক এবং খোলা জায়গা রক্ষণাবেক্ষন, জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন সনদ বিতরণ, ট্রেড লাইসেন্স প্রদান, হোল্ডিং ট্যাক্স সংগ্রহসহ বেশ কিছু মৌলিক সেবা দিয়ে থাকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। কিন্তু সেবাদানই যদি করপোরেশনের মূলকাজ হয় তাহলে সেবা পেতে কেন এত ভোগান্তি?

ডিএনসিসি প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ বলেন, 'কুরবানীর আগে সবগুলো ওয়ার্ড অফিস ফাংশনাল দেখবেন। কুরবানীর মধ্যে ঢাকার ট্রান্সফর্মেশনটাও আমরা শুরু করতে পারবো আশা করি। সুতরাং অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের জায়গা থেকেও আমরা ফাংশনাল করে ফেলতে পারবো কুরবানীর আগে।'

উত্তর সিটির দাবি দুই তৃতীয়াংশ জনবল দিয়ে চলছে ডিএনসিসি। যদিও সেবার মান কমেছে এমন কথা স্বীকার করলেন প্রশাসক।

মোহাম্মদ এজাজ বলেন, 'সংকট অনেক, মাদের যতটুকু সার্বিস দেয়া প্রয়োজন তার তিনভাগের একভাগ লোকজন আছে আমাদের। এরমধ্যে অনেকে হচ্ছে অনেক পুরাতন। শহর তো ডায়নামিক, শহর তো প্রতিদিন পরিবর্তন হয়। প্রতিদিন নতুন নতুন বাস্তবতা। এই চ্যালেঞ্জিং পরিবেশে কাজ করার জন্য সবসময় নতুন যারা আছে তাদের ফিটিং করতে হবে। আমাদের নিয়মিত বিক্রুটমেন্ট প্রসেসটাও বন্ধ। সাথে সাথেই মিনিমাম সার্ভিস দেয়ার জন্য যা দরকার, সেটা আমরা যথাযথভাবে না পারলেও আমরা সেই প্রসেসিং শুরু করে দিচ্ছি।'

এ অবস্থায় করপোরেশনে জনসংখ্যার বিপরীতে লোকবল নিয়োগ দেয়ার পরামর্শ নগর পরিকল্পনাবিদদের। সেইসঙ্গে সেবা দেয়ার মানসিকতায় পরিবর্তন আনার তাগিদ তাদের।

নগর পরিকল্পনাবিদ আকতার মাহমুদ বলেন, 'সিটি করপোরেশনের হেডঅফিস, আঞ্চলিক অফিস এবং ওয়ার্ড অফিস, তিনটি জায়গা তেকে সিটি করপোরেশনের যে আইনটি আছে তার অধীনে প্রায় ২৮টি সেবা নাগরিকদের দেয়া হয়ে থাকে। এখন এই গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে যখন আমরা দেখলাম যে প্রতিটি স্থানীয় সরকারের অফিস থেকে তাদের যে রাজনৈতিক রি-প্রেজেন্টেটিভ আছে মানে জনগণের প্রতিনিধি যারা আছেন, তারা এখন অনুপস্থিত। সেকারণেই মূলত ওয়ার্ড ফিসে তাদের কার্যক্রম যেমন ব্যাহত হচ্ছে তেমনি সাধারণ মানুষ তাদের যেসকল সেবাগুলো আছে সেগুলো পেতে অসুবিধা হচ্ছে।'

সিটি করপোরেশনের সেবা নিয়ে সাধারণ নাগরিকদের অভিযোগ নতুন নয়। নগরপিতা বা কর্মকর্তারা পরিবর্তন হলেও বদলায় না সংস্থাটির সেবার মান। কিছু জায়গায় সেবাগুলো নামে ডিজিটাল হলেও বাস্তবে তা ফাইলবন্দি। তাই নাগরিকদের প্রত্যাশা জনবল বাড়ানোর আগে সিটি করপোরেশনের সেবাদাতাদের মানসিকতার ইতিবাচক পরিবর্তন।

এসএস