ঢাকাসহ আশপাশের হাসপাতালগুলোয় বেড়েছে দগ্ধ রোগীর সংখ্যা

স্বাস্থ্য
বিশেষ প্রতিবেদন
0

শীত মৌসুমে ঢাকাসহ আশপাশের হাসপাতালগুলোতে বেড়েছে দগ্ধ রোগীর সংখ্যা। জেলা হাসপাতালে দগ্ধ রোগীরা পর্যাপ্ত সেবা না পেয়ে ছুটছেন শহরে। যথাযথ চিকিৎসার অভাব ও দেরিতে হাসপাতালে আসায় বাড়ে মৃত্যুঝুঁকি।

কুয়াশার চাদরে মোড়া এই জনপদ। শীত উপেক্ষা করে কৃষকের কর্মযজ্ঞ যেন নিত্যদিনের। তবে এবছর ঠান্ডা তুলনামূলক কম থাকলেও বয়স যেন তা মানতে নারাজ। যেখানে শিশু আর বৃদ্ধরা থাকে সবচেয়ে বিপাকে।

গ্রাম-মফস্বলে খড়কুটা দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে শীত নিবারণের উপায় বেশ পুরনো। শীতের তীব্রতা অনুযায়ী সকাল কিংবা সন্ধ্যার পর এ আয়োজন চলে প্রায় প্রতিটি পাড়া-মহল্লায়। তবে এ আগুন যতটা উষ্ণতা দেয় তা চেয়েও বেশি উদ্বেগ বাড়ায়। কেননা এমন আগুন পোহাতে গিয়ে প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও পুড়ছে শরীর, ঝলসে যাচ্ছে ভবিষ্যৎ।

শীত মৌসুমে ঢাকার পার্শ্ববর্তী গাজীপুর সদর হাসপাতালে দগ্ধ রোগী বেড়েছে দ্বিগুণ। তবে হাসপাতালটিতে বার্ন ইউনিট না থাকায় প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে পাঠানো হয় রাজধানীর জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে।

শহীদ আহসান উল্লাহ জেনারেল হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার ড. মো. নাফিস মজিদ বলেন, 'পাঁচ থেকে দশ শতাংশ পোড়ার ক্ষেত্রে যাদের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক দৈনন্দিন কাজকর্ম করা কষ্ট হয়ে যায় তাদেরকে আমরা ভর্তি রাখি। কিন্তু কিছু জটিল রোগী থাকে যাদেরকে আমরা রেফার করে দিই।'

উন্নত চিকিৎসার জন্য জাতীয় বার্নে আসা চার বছরের হুমায়রা। হাত-পায়ের স্তব্ধতা, শরীরের জড়তা আর অবুঝ চাহনি যেন বলে দিচ্ছে শরীর নয় পুড়েছে তার দূরন্তপনা।

হুমায়রা পা থেকে বুক পর্যন্ত ব্যান্ডেজে মোড়ানো শরীর নিয়ে শুয়ে আছে হাসপাতালের শয্যায়। গোসলের জন্য গরম করে রাখা পানিতে পড়ে পুড়ে যায় হাত, পা পিঠের অংশ।

হুমায়রার বাবা বলেন, 'গরম পানির বোল ছিল, ব্রাশ করতে গিয়ে সেই পানিতে বসে গিয়েছিল। তখন উঠার চেষ্টা করার সময় হাত দুইটাও পানিতে ঢুকে গিয়েছিল। প্রায় ১৮ শতাংশ ইনজুরি হয়েছে।'

গরম দুধ মুখে পড়ে বরিশাল থেকে আসা ১৫ মাসের শিশু ফাতিহা, চার বছরের ইউসুফ কিংবা রাজধানীর মাতুআইলের আরোয়া, অধিকাংশেরই গল্প হুমায়রার মতো।

ফাতিহার মা বলেন, 'দুধ জাল করে টেবিলের উপর রেখেছিলাম, আসতে আসতে ও দুধ কাত করে ফেলে দিয়েছে।'

শিশু থেকে তরুণ কিংবা বৃদ্ধ, কেউ গোসলের গরম পানিতে আহত, কেউ আগুন পোহাতে গিয়ে দগ্ধ, আবার কেউ গরম দুধ, ডাল, ভাতের মাড় বা এ জাতীয় জিনিসে পুড়ে দগ্ধ। অনেকে গ্যাস সিলিন্ডার, বিদ্যুৎস্পৃষ্টসহ অন্য আগুনে দগ্ধ হয়েছেন। যাদের বেশিরভাগই ২০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত পোড়া। ৩০ থেকে ৭০ শতাংশ পুড়ে যাওয়া রোগীও ভর্তি আছেন।

জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. ফোয়ারা তাসনিম বলেন, 'এ সময়ে অন্য প্লাস্টিক সার্জারির রোগীদের আমরা আসলে ভর্তি নিতে পারি না। কারণ বার্ন এত বাড়ে। পুরুষ রোগীর তুলনায় এই সময়ে শিশুদের সংখ্যা বেশি থাকে, নারীদের সংখ্যা বেশি থাকে। এবং বয়স্কদের সংখ্যাও বেশি থাকে।'

জাতীয় বার্নে গেল বছর জরুরি বিভাগে সেবা নিয়েছেন ১৬ হাজার ৬২৩ জন পোড়া রোগী, এর মধ্যে গুরুতর ছয় হাজার ২৪১ জন। আর মৃত্যু হয়েছে এক হাজার ১৮৯ জন। তবে এই ডিসেম্বরে মৃতের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ১৫৯ জন। পোড়া রোগী ভর্তির দিকে থেকে জানুয়ারি মাস শীর্ষে রয়েছে। এছাড়া নতুন বছরের ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত বহির্বিভাগে ছয় হাজার ৫৪৩ জন, জরুরিতে এক হাজার রোগী সেবা নিয়েছেন। আর ভর্তি হয়েছেন ৪৯৮ জন দগ্ধ রোগী। যার মধ্যে মারা গেছেন ৮৯ জন।

জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের যুগ্ম পরিচালক ডা. মো. মাফরুল ইসলাম বলেন, 'এডাল্ড একটা মানুষের ১৫ ভাগের বেশি পুড়লে অবশ্যই তাকে স্যালাইন পুশ করতে হবে। আর বাচ্চাদের ক্ষেত্রে আরও কম। তাদের ১০ ভাগের বেশি পুড়লেই স্যালাইন পুশ করতে হবে। এবং প্রথম ২৪ ঘণ্টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ সময়। ওই সময়ের মধ্যে না করলে বাচ্চার যে ইলেকট্রোলাইজ ইমব্যালেনজড হয়ে যায়, এটা কিন্তু রিকভার করা অনেক টাফ হয়ে যায়।'

উপজেলা ও জেলা হাসপাতালে পোড়া রোগীদের সঠিক চিকিৎসা না থাকায় ৫০ ভাগ রোগীই দুর্ঘটনার প্রথম ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে ভর্তি হতে ব্যর্থ হন। এতে শারীরিক ও আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি পঙ্গুত্ব ও মৃত্যুর ঝুঁকি বেড়ে যায় বলে জানান চিকিৎসকরা।

এসএস