অর্থনীতি
বিশেষ প্রতিবেদন
0

সমীক্ষার সিকিভাগ যানবাহনও চলে না কর্ণফুলী টানেলে

টোল আদায়ের তুলনায় ব্যয় বেশি

উদ্বোধনের এক বছরে প্রায় শতকোটি টাকা লোকসানে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত বঙ্গবন্ধু টানেল। সমীক্ষায় ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানো যানবাহনের সংখ্যার সিকিভাগও চলে না বর্তমানে। অথচ টানেলের চাইতে এখনও ৬ গুণ বেশি জনপ্রিয় আগের শাহ আমানত সেতু, আয়ও দ্বিগুণের বেশি। টানেল যেখানে গাড়িশূন্য, সেখানে সেতুতে রীতিমতো যানজট।

২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর খুলে দেয়া হয় কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত বঙ্গবন্ধু টানেল। আশা করা হয়েছিলো, প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকার এ টানেল পাল্টে দেবে দক্ষিণ চট্টগ্রামে অর্থনীতির চিত্র। গড়ে উঠবে ওয়ান সিটি টু টাউন। কিন্তু ঠিক এক বছর পর সে প্রত্যাশা আর প্রাপ্তিতে অনেক তফাত। যে সংখ্যক গাড়ি চলাচলের কথা বলা হয়েছিল তার সিকিভাগও এখন চলছে না।

দর্শক এই হচ্ছে কর্ণফুলী টানেলের টোলপ্লাজার স্বাভাবিক সময়ের দৃশ্য। একেবারেই যানবাহন শূন্য। টানেল নির্মাণের আগে করা সমীক্ষায় দাবি করা হয়, এই টানেল দিয়ে প্রথম বছরে প্রতিদিন গড়ে ১৭ হাজারের বেশি যান চলাচল করবে। যদিও সেতু কর্তৃপক্ষের তথ্য বলছে, বর্তমানে প্রতিদিন গড়ে ৪ হাজারের মত যান চলাচল করছে টানেলটিতে। যা লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ২৪ শতাংশ।

সেতু কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, বর্তমানে টানেল থেকে দৈনিক গড়ে টোল আদায় ১২ লাখ টাকা। যেখানে টোল আদায় ও রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ দিনে গড় ব্যয় সাড়ে ৩৭ লাখ টাকা। অর্থাৎ বছরে আয় ৪৩ কোটি, ব্যয় ১৩৫ কোটি টাকা। সে হিসাবে গত ১ বছরে লোকসান ৯৩ কোটি টাকার বেশি।

টানেল ঘিরে দক্ষিণ চট্টগ্রাম তথা আনোয়ারা, কর্ণফুলীতে একবছরেও কোনো শিল্প উন্নয়ন হয়নি। বর্তমানে কিছু লোকাল বাস, বিনোদনের জন্য ব্যক্তিগত গাড়ি আর হাতেগোনা কিছু পণ্য পরিবহন হয় টানেল দিয়ে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিগগিরই পর্যটন শহর কক্সবাজার পর্যন্ত সড়ক না হলে, আগামীতে এ টানেল বড় বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।

সড়ক ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়া বলেন, ‘ওয়ান সিটি টু টাউন কি টানেল হলেই হয়? টানেল হওয়ার আগে কী ওয়ান সিটি টু টাউন হয়নি? নদীর দক্ষিণ পাড়ে কোনো উন্নয়ন হয়নি, কোনো শিল্পকারখানা হয়নি। উত্তরে যা কিছু আছে, মিরসরাই ইকোনমিক জোন হওয়ার কথা রয়েছে। কিছুই হয়নি। তাহলে ওনারা কেমন করে ভবিষ্যতবাণীটা করলেন যে টানেল শেষ হওয়ার আগে ওইখানে সব ইন্ডাস্ট্রি হয়ে যাবে।’

তিনি বলেন, ‘আসল কথা হচ্ছে দুরদর্শিতার অভাব। দেশকে কীভাবে গড়ে তুলবো সে লক্ষ্য কিন্তু আমাদের নেই।’

টানেলের বিকল্প শাহ আমানত সেতু। টোল প্লাজা যখন পরিবহন শূন্য, তখন এ সেতুতে যানজট। পরিসংখ্যান বলছে, টানেলে যেখানে প্রতিদিন গাড়ি চলাচল করে ৪ হাজার, সেখানে শাহ আমানত সেতুতে করে ২৫ হাজারের কাছাকাছি। প্রায় ৬ গুণ বেশি । টানেলে ১২ লাখ টাকা দৈনিক আয়, আর সেতুতে হয় ২৫ লাখ।

প্রশ্ন হচ্ছে কেন টানেলের বদলে সেতু এতো জনপ্রিয়? চালক ও যাত্রীরা বলছেন, টানেলের টোল হার আড়াই থেকে ছয় গুণ পর্যন্ত বেশি। টোল হারের এ পার্থক্যই টানেলে যানবাহনের সংখ্যা বাড়ার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। এছাড়া টানেলের মুখ থেকে শহর পর্যন্ত স্বল্পমূল্যের কোনো গণপরিবহন চালু হয়নি এক বছরেও।

তবে এখনও এ জনপদের মানুষের কাছে নদী পারাপারের সবচেয়ে জনপ্রিয় মাধ্যম হাজার বছর ধরে চলে আসা সাম্পান। মাত্র ১৫ টাকায় নদী পারাপার করা যায় বলে, কর্মজীবী মানুষ, শিক্ষার্থী কিংবা নিম্ন আয়ের মানুষের ভরসা নদী পথ। বলা যায়, হাজার কোটি টাকার আলো ঝলমলে টানেল কিংবা আধুনিক সেতু দৃষ্টিনন্দন সেতুর চাইতে সস্তায় নদী পারাপারকেই বেছে নিয়েছে এখানকার মানুষ।

এএইচ