নগর জীবনে যান্ত্রিক পাখার প্রচলন বাড়লেও গ্রামঞ্চলে এখনও কদর আছে হাতপাখার। প্রচণ্ড গরমে গ্রামের গৃহিণীর হাতে এখনও তালপাতার একটি পাখা বাড়তি দরদ বয়ে আনে। আবহমান গ্রাম-বাংলার ঋতুচক্রে বৈশাখ এলেই বাড়ে পাখা তৈরির ব্যস্ততা। গ্রাম-গাঁয়ের পাখাপল্লীতে চলে নানান আয়োজন।
বগুড়ার কাহালু উপজেলার আতালপাড়া, যোগীর ভবন, আলোড়া উত্তরপাড়া গ্রামে পুরোদমে চলছে হাতপাখা তৈরির কাজ। পরিবারের প্রতিটি সদস্যের শ্রম-ঘামে তৈরি হচ্ছে দৃষ্টিনন্দন হাতপাখা। তালপাতা সংগ্রহ কিছুটা কষ্টসাধ্য হলেও বিক্রি বাড়ায় খুশি কারিগররা।
পাখার কারিগররা বলেন, ‘বাপ-দাদার আমল থেকে এই কাজ হচ্ছে। দিনে দিনে হাতপাখার দামও বেড়েছে। তবে তালপাতা সংগ্রহই বেশি কষ্টের হয়ে যায়।’
এছাড়া সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে বাড়বে হাতপাখার বাজার, লাভবান হবেন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা।
বৈদ্যুতিক পাখার চাহিদার কাছে তালপাতার পাখা হার মেনেছে মনে হলেও চট্টগ্রামের চন্দনাইশের জিহস ফকির পাড়া গ্রামের ব্যস্ততা সেই ধারণা নিয়ে দ্বিতীয়বার ভাবতে বাধ্য করবে। এখানকার প্রায় ৫শ'র বেশি পরিবার যুগের পর যুগ ধরে তৈরি করছে তালপাতার পাখা। শুধু বৈশাখী মেলাকে কেন্দ্র করেই এই এলাকার প্রতিটি পরিবার ২ থেকে ৭ লাখ টাকা আয় করে থাকেন। আগের চেয়ে বিক্রি কমলেও এখন ভালো দাম পাওয়া যায় বলে জানান তারা।
বৈশাখী মেলা ও জব্বারের বলী খেলা এসব পাখা বিক্রির প্রধান মৌসুম। একেকটি হাতপাখা পাইকারিতে বিক্রি হয় ১৮০ থেকে ৩০০ টাকায়। শুধু পাখাকেন্দ্রিক এই গ্রামে এক মৌসুমে অন্তত ২৫ কোটি টাকার বাণিজ্য হয়।
মেলা উপলক্ষে গ্রামে বেপারিদের আনাগোনা বেড়ে যায়। বাড়ি বাড়ি গিয়ে পাখা সংগ্রহ করেন তারা। আবার অনেকেই অগ্রিম অর্ডার দিয়ে রাখেন।
একেকজন কারিগর দিনে ৪ থেকে ৫টি পাখা তৈরি করতে পারেন। বংশ পরম্পরায় পাখা তৈরি করছেন এসব পরিবার। ফটিকছড়ি, রাঙামাটি, রাউজান, থেকে সংগ্রহ করা হয় তালপাতা। আর বাঁশ-বেতের মতো উপকরণ সংগ্রহ করা হয় পার্বত্য এলাকা থেকে। তবে, বাঁশ-বেত ও তালপাতার অপ্রতুলতায় বাড়ছে চ্যালেঞ্জ। কাঁচামালের দামের সঙ্গে পাখার দামও বেড়েছে।
চন্দনাইশের এই গ্রামের পাখার কারিগররা ঐতিহ্যগতভাবে এই শিল্পটিকে টিকিয়ে রেখেছেন। তবে নতুন প্রজন্ম এই পেশা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা চান এখানকার কারিগররা।
বছরের অন্যসময় কৃষি কিংবা অন্য পেশায় ব্যস্ত থাকলেও গ্রীষ্মে হাতপাখা নিয়ে ফেরি করেন দিনাজপুরের তরুণ নয়ন মিয়া। চৈত্র থেকে জৈষ্ঠ্যের শেষ পর্যন্ত পার্বতীপুর রেলওয়ে জংশনের বিভিন্ন প্লাটফর্মে ক্রেতা আকর্ষণের চেষ্টা তার নিত্যদিনের কাজ।
তবে বছর পাঁচেক আগে দৈনিক হাজারখানেক হাতপাখা বিক্রি হলেও এখন তা কমে শতকের নিচে ঠেকেছে। ট্রেনের বিলম্ব কিংবা যাত্রীচাপ না বাড়লে সেদিন বলার মতো কোনো বিক্রি হয় না। তবে কালেভদ্রে শখের বসে এখনো হাতপাখা কেনেন অনেকে।
নয়ন মিয়া বলেন, ‘হাতপাখার বেচাকেনা আগের চেয়ে কমেছে। তবে গরম বেশি হলে হাতপাখার চাহিদা বেড়ে যায়।’
একসময় উত্তরে বাঁশের অংশ বিশেষ, পুরনো কাপড় আর তালপাতা দিয়ে তৈরি হাতপাখার কদর থাকলেও এখন সে যায়গা প্লাস্টিকের পাখা দখল করেছে।