বিশেষ প্রতিবেদন
দেশে এখন
0

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহতদের অনেকেই মানসিক ট্রমায় ভুগছেন

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের নির্মমতায় আহত অনেকেই ভুগছেন মানসিক ট্রমায়। যা থেকে বের হতে পারছেন না প্রত্যক্ষদর্শী চিকিৎসকরাও। মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ছাত্রজনতার প্রত্যাশার প্রতিফলন না হলে এ সমস্যা আরো বাড়বে।

‘পায়ে যখন গুলিটা লাগে তা ভেতরে ঢুকে ফেটে যায়, এতে আমার পা ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। যখন আমাকে মিটফোর্ড হাসপাতালে নেয়া হয়, তখন আমার শরীর নিথর হয়ে আসছিল, মনে হচ্ছিল আমি মরে যাচ্ছি। ভাবচ্ছিলাম আমরা যে আন্দোলন ও সংগ্রাম করলাম এর ফলটা আর দেখে যেতে পারবো না। ডাক্তার আমাকে বারবার বলছিলেন- তুমি মারা যাওনি, বেঁচে আছো।’ এই কথাগুলো বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে গুরুতর আহত ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ আল ইমরানের।

গেল ১৯ জুলাই আন্দোলনের অন্যতম স্পট যাত্রাবাড়ীতে পুলিশের ছোঁড়া ছয় ইঞ্চি তরল বারুদযুক্ত ইলেকট্রিক বুলেটে বিদ্ধ হয় সে। এতে ৯ টুকরো হয়ে পায়ের মাংসপেশি ও হাড় উড়ে যায় তার।

৫ মাসের বেশি সময় পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ইমরানের পায়ে অপারেশন হয়েছে ২০ বার। স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন কিনা তাও অনিশ্চিত। শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার আগে, ২৭ জুলাই হাসপাতালে আহতদের দেখতে এসে- বিরোধীমতের হওয়ায় চিকিৎসা বন্ধ করে দেয় তার। অতঃপর চিকিৎসার অভাবে পায়ে পঁচন ধরে কেটে ফেলার উপক্রম হয়। অভ্যুত্থান পরবর্তী এই যোদ্ধা এখন ভুগছেন মানসিক ট্রমায়।

আব্দুল্লাহ আল ইমরান বলেন, ‘এমন মানুষ দেখেছি যাকে সবাই ধরে নিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু যার বুকটা ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। চার-পাঁচটা গুলি লেগেছিল তার মাথায় আর পায়ে, এগুলো আসলে এখনো আমাকে তাড়া করে বেড়ায়।’

নানা সংকটেও যে চিকিৎসকরা আহতদের সেবা দিয়ে গেছেন তাদেরও মানসিক অবস্থা একইরকম। আহতদের দীর্ঘ সারি, নিষ্ঠুর জখম এখনও তাদের তাড়িয়ে বেড়ায়।

নিটোর সিনিয়র কনসালট্যান্ট ডা. মো. জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘আসলে চারমাস তো তেমন বেশি একটা সময় না। আমরা এখনো এসব স্মৃতি কাটিয়ে উঠতে পারিনি। রাতের এখনো ঠিকমতো ঘুমাতে পারি না। ঘুমের মধ্যে এসব দৃশ্য ভেসে উঠে। জুলাই থেকে ৫ আগস্ট অনিশ্চয়তার যে টেনশন তা হয়ত কমেছে কিন্তু অন্যসব স্মৃতি অম্লান রয়ে গেছে।’

মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আন্দোলনে আহত বহু শিক্ষার্থী শারীরিকভাবে সুস্থ হলেও এখনও মানসিক ট্রমায় ভুগছেন। যাদের ভেতরে অস্বাভাবিক আচরণ এবং জীবনের প্রতি বিরক্তি লক্ষ্য করা গেছে- এ থেকে আত্মহত্যার প্রবণতা আসতে পারে বলে শঙ্কা মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ডা. মোহাম্মদ মুনতাসীর মারুফ বলেন, ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থানে যারা আহত বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, সেই ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ যদি তারা পান- তাহলে তাদের মনে একটা রিলিফ ফিল হবে। এতে তাদের একটা ইমোশনাল ব্যালেন্স তৈরি হবে। এটা তাদেরকে মানসিক কষ্ট কমাতে সাহায্য করবে। তারা যে বিচার চাইছেন, তাদের প্রতি যে অন্যায় হয়েছে, সেই বিচারটা যদি তারা দেখতে পান- তাহলে তাদের মানসিক কষ্টটা অনেকখানি লাঘব হবে।’

সরকারি ৩৫টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বহির্বিভাগে মানসিক রোগীদের চিকিৎসা দেয়া হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মানসিক রোগ বিভাগ নেই। ওষুধ দিয়ে এ রোগীদের শান্ত করার পর স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নেই। তারপরও জুলাই যোদ্ধাদের জন্য কাজ করা হচ্ছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল পরিচালক ডা. মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পক্ষ থেকে আমরা এন্টি ডিস্ক্রিমেনেটারি ইউনিট তৈরি করেছি। তাদের জন্য আলাদা একটা ওয়ার্ড তৈরি করেছি। এছাড়া ২০ শয্যা বিশিষ্ট একটা ওয়ার্ড সব সময় রেডি করা আছে।’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহতদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিশ্চিতে সরকার প্রস্তুত ও আন্তরিক বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. আবু জাফর।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, ‘যারা মারা গেছেন বা যারা হাসপাতালে আছেন, তাদের কারো পা নেই, কারো হাত নেই, কেউ আবার চোখ থাকা সত্ত্বেও দেখতে পারছেন না। তারা কিন্তু একটা সুন্দর বাংলাদেশ ছাড়া আর কিছু চায়নি। তাদের যে চিকিৎসা এখনো বাকি রয়েছে সে ব্যাপারে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তথা স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূর জাহার বেগম, স্বাস্থ্য বিভাগের সিনিয়র সচিব ও সকল কর্মকর্তা এবং অন্যান্য মন্ত্রণালয়সহ সম্মিলিতভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছে।’

সম্প্রতি জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের গবেষণা তথ্য বলছে, গণঅভ্যুত্থানে আহতদের মধ্যে প্রায় ৭৫ শতাংশ হালকা থেকে গুরুতর বিষণ্নতায় ভুগছেন। তাদের মধ্যে ২৫ শতাংশের অবস্থা আরও গুরুতর। ২০ শতাংশের বেশি অত্যন্ত গুরুতর উদ্বেগের সঙ্গে লড়াই করছেন। আর ৬০ শতাংশ ভুগছেন মানসিক চাপে।

এএম