এখন টিভিকে হাসপাতালের কাগজপত্র দেখাচ্ছেন রোগীর মা। ছবি: এখন টিভি
ডেঙ্গু আক্রান্ত একমাত্র মেয়েকে নিয়ে একটা সিটের জন্য কীভাবে হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরেছেন 'এখন টিভি'কে তারই কাগজপত্র দেখান রাজধানীর নন্দীপাড়া এলাকার স্বপ্না আক্তার। মুগদা হাসপাতালের জরুরি বিভাগে রাতভর জ্বরে জ্ঞান হারানো মেয়েকে নিয়ে কেঁদেছেন একটি সিটের জন্য।
স্বপ্না আক্তার বলেন, 'আমি একা মানুষ, আমার কেউ নেই। আমার মা-বাবা তো আগেই মারা গেছে। আমার এই মেয়ের বাবাও মারা গেছে। আর কেউ নেই, এই মেয়েটাই একাই আমার সম্পদ। এখানে এসে বলছি যে, দেখেন আমার মেয়েটাকে ভর্তি রাখেন, ও মেধাবী ছাত্রী, পরীক্ষা চলে কিন্তু পরীক্ষা দিতে পারছে না। এখানে যদি ভর্তি না করাতো। আমার মেয়েটা মারা গেলে আমার কেউ নেই।'
প্রতিবছরের মতো এবারো ডেঙ্গু রোগীর চাপ সামলাতে অনেকটা হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসকরা। চলতি মাসে মুগদা হাসপাতালে ঢাকার ভেতরের রোগীর পাশাপাশি বেড়েছে ঢাকার বাইরের ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা।
মাদারীপুর থেকে অসুস্থ মেয়েকে নিয়ে এসেছেন হালিমা বেগম। মা জ্বরে কাবু তাই তিন মাসের বাচ্চাকে সামলাচ্ছেন তার দাদি আর নানি।
হালিমা বেগমের মা বলেন, 'শরীর ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে জ্বর আসতো। যখন জ্বর ওঠে তখন শরীরে কাঁপুনি ওঠে।'
এছাড়া ঢাকার বাইরে বন্যা কবলিত এলাকা থেকে এসেছেন অনেকেই, যাদের অনেকের শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি হচ্ছে বলে জানান স্বজনরা।
রোগীর সাথে আসা একজন বলেন, 'মশার উপদ্রব বেড়ে যাওয়ার কারণে ডেঙ্গু হয়েছে অনেক। আমি ফেনী থেকে রোগী নিয়ে এসেছি, টেস্ট করতে হলে যে আমাদের যেতে হয়, এটা আমাদের হয়রানি হয় অনেক।'
হাসপাতালে বেড়েই চলেছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা। ছবি: এখন টিভি
মুগদা হাসপাতালটির সহকারি পরিচালক জানান, ফ্লুইড সাপোর্ট ছাড়া রোগী রেফার করার কারণে শক সিন্ড্রোমে চলে গিয়ে মৃত্যুঝুঁকি বাড়ছে ঢাকার বাইরের রোগীদের।
মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপ-পরিচালক সত্যজিত কুমার সাহা বলেন, 'যদি কোনো রেফার করা প্রয়োজন হয়, তাহলে অবশ্যই এটা সাপোর্ট দিয়ে রোগীকে রেফার করতে হবে। রোগী শকে থাকার পর যদি মুগদা বা ঢাকা মেডিকেলে রেফার করে দেয় তখন আসার সময় চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা সে সাপোর্ট ছাড়া চলে আসে।'
ডিএনসিসি হাসপাতালেও চলতি মাসে বাড়তে শুরু করেছে রোগীর সংখ্যা। মৃত্যু বাড়ার পেছনে রোগীদের একাধিক শারীরিক জটিলতা, দেরিতে হাসপাতালে আসা, ঢাকার বাইরের রোগীদের অতিউৎসাহী হয়ে ঢাকায় আসাকে দায়ী করলেন হাসপাতালটির পরিচালক।
ডিএনসিসি হাসপাতালের পরিচালক এ কে এম জহিরুল হোসাইন খান বলেন, 'রোগী যখনই বাড়ে তখনই মৃত্যু বাড়ে। বিশেষ করে ডেঙ্গুর সাথে যদি তার অন্য কোনো ফ্যাক্টর থাকে তখন কিন্তু তার ঝুঁকি বেড়ে যায়। এছাড়াও অনেক সময় রোগীরা দেরিতে রেসপন্স করলে তার মৃত্যু সম্ভাবনা বেড়ে যায়। ঢাকার বাইরে বরিশাল, পটুয়াখালী থেকে বেশি রোগী আসছে। ঢাকাতে যে সেবা পাবেন, বরিশাল মেডিকেলেও একই সেবা পাবেন। আপনাদের ঢাকার দিকে আসার দরকার নেই।
শুধু এই মাসেই ডেঙ্গুতে মৃতের সংখ্যা ৪০ ছাড়িয়েছে। গত এক সপ্তাহের পরিসংখ্যান দেখলে, গত ১৪ সেপ্টেম্বর ডেঙ্গুতে তিন জন, ১৫ সেপ্টেম্বর এক জন, ১৬ সেপ্টেম্বর এক জন, ১৭ সেপ্টেম্বর পাঁচ জন, ১৮ সেপ্টেম্বর ছয় জন, ১৯ সেপ্টেম্বর তিন জন ও ২০ সেপ্টেম্বর দুই জনের মৃত্যু হয়েছে।
হাসপাতালের বেডে জায়গা না পেয়ে মেঝেতেই আছেন ডেঙ্গু রোগীরা। ছবি: এখন টিভি
ঢাকার বাইরে স্বাস্থ্য কাঠামো থাকলেও জনবল নেই। তাই চিকিৎসা ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণের পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. মুশতাক আহমেদ বলেন, 'একটা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সমস্ত ধরনের রোগী একসাথে ভিড় করছে, এটাকে আমাদের বিকেন্দ্রীকরণ করা প্রয়োজন। যতদ্রুত সম্ভব এই বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। গ্রামাঞ্চলে বিকেন্দ্রীগত কাঠামো আছে। কমিউনিটি ক্লিনিক আছে, উপজেলা হাসপাতাল আছে। সেখানে কিন্তু প্রয়োজনীয় জনবল এবং সরঞ্জাম নেই। সেখানে কাঠামোগত কোনো সমস্যা নেই। আবার শহর অঞ্চলে সবকিছু মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। যথেষ্ট লজিস্টিক আছে, ডাক্তারদেরও বিভিন্ন জায়গা থেকে এখানে নিয়ে আসা হয়। কিন্তু তারা রোগীর চাপ সামলাতে পারে না।'
এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে বিজ্ঞান ভিত্তিক সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনার প্রয়োগ না ঘটালে অক্টোবরে ডেঙ্গু আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ কীটতত্ত্ববিদদের।
কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার বলেন, 'জুলাই মাসেই আমরা আমাদের গবেষণা থেকে বলেছিলাম যে সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি খুব খারাপ হবে। তখন স্পষ্ট বলেছিলাম, যদি এখনই এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করা না যায় তাহলে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে এই মুহূর্তে আমাদের হটস্পট ম্যানেজমেন্ট করতে হবে। রোগীর ঠিকানা অনুযায়ী তার বাড়ির ২০০ গজের মধ্যে এডিস মশার মৃত্যু নিশ্চিত করতে হবে।'
ডেঙ্গুতে মৃত্যুঝুঁকি কমাতে জনসম্পৃক্ততার মাধ্যমে সব পক্ষকে একসঙ্গে কাজ করার পাশাপাশি মানুষকে সচেতন হবার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।