চৌঠা আগস্ট। সেদিন ফেনীর এক প্রান্তে চলছিলো শ্রাবণ ধারা। বানের জলে ভাসছে জনপদ-মাঠ-ক্ষেত, তখন আরেক প্রান্তে চলে বর্বর হামলা ও গুলিবর্ষণ। সেই হামলায় ঝরে পড়ে ডজন খানেক আন্দোলনকারীর তাজা প্রাণ।
তাদেরই একজন সদরের তুলাতুলি এলাকার ছাইদুল হক শাহী। মহাসড়কের মহীপালে আন্দোলনরত ছাইদুল দুর্বৃত্তদের গুলিতে প্রাণ হারান। 'নতুন খামে পুরনো চিঠি' লেখা যে টি-শার্ট পরে আন্দোলনে যেতেন শাহী। ছেলের সেই টি-শার্ট জড়িয়ে ধরে কাঁদেন মা। ছেলের কাপড় দেখে, গন্ধ শুঁকে ছেলের স্পর্শ খোঁজেন।
শাহীর মা রাহেনা বেগম বলেন, ‘অনেক আদরে ছিল, কষ্ট করে ছেলেদের মানুষ করেছি।’
লেগুনাচালক দরিদ্র বাবা শাহীকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়িয়েছেন, অর্থকষ্টে নিয়মিত পড়ালেখা করতে পারতেন না।
তারপরও স্নাতকে ভর্তি হন মীরসরাইয়ের বারইয়ার হাট সরকারি কলেজে। ছেলেকে ডাক্তার বানানোর স্বপ্ন কেড়ে নিলো ঘাতকের বুলেট। এখন অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে বিচারের আশায় পরিবার ও স্বজনরা।
বাবা রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘বড় একটা আশা ছিল আমার ছেলেকে ডাক্তার বানাবো। সন্ত্রাসীদের কারণে ডাক্তার বানাতে পারলাম না। দেশের জন্য শহীদ হয়েছে।’
শাহীর ভাই বলেন, ‘আমার ভাই খুব ভালো একটা ছেলে ছিল, মানবিক ছিল। সে ২০১৮ সালের কোটা আন্দোলনেও যুক্ত ছিল।’
পরশুরামের রাজেসপুর গ্রামের আরেক শিক্ষার্থী ইকরাম হোসেন কাউছার। ঢাকার কবি নজরুল কলেজে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর পড়ুয়া কাউছার থাকতেন লক্ষ্মীবাজারের একটি মেসে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময়ে গেল ১৭ ও ১৮ জুলাই রান্না হয়নি মেসে। তাই খাবার খেতে ১৮ জুলাই দুপুরে বের হন। জুমার পর সড়কের পাশে এক ভ্রাম্যমাণ হোটেল থেকে ভাত চেয়ে খান কাউছার। পরে দোকানদার রাতে খাওয়ার জন্য একটি বিস্কুটের প্যাকেট ধরিয়ে দেন।
এরপর সড়ক পার হওয়ার সময় প্যাকেটটি ছিঁড়ে বিস্কুট মুখে দেয়ার সময় পেছন থেকে মাথায় গুলি এসে লাগে। মুহূর্তেই কাউছারের মগজ ছিটকে পড়ে সড়কে।
দিন কয়েক আগে বাবাকে ফোন করে টাকা পাঠাতে বলেছিলেন। উদ্দেশ্যে বিসিএসের প্রস্তুতির বই-পত্র কেনা। কিন্তু, কাউছারের সে স্বপ্ন শেষ হয়ে যায় গুলিতে।
প্রাথমিকে বৃত্তি, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে জিপিএ ফাইভ এবং স্নাতকে অর্থনীতি বিভাগ থেকে প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ কাউছারের এমন মৃত্যু মানতে পারছেন না স্বজন ও গ্রামবাসী।
স্কুলশিক্ষক বাবার স্বপ্ন ছিলো সন্তান পড়ালেখা শেষে হাল ধরবেন সংসারের। এখন সেই বাবার চোখে অন্ধকার। চান সন্তান হত্যার বিচার।
কাউছারের বাবা মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, অন্তিমকালে আমার পাশে থেকে ছেলে আমাকে কবরে নামাতো, মাটি দিত। সেখানে আজকে তার লাশ আমাকে বহন করতে হয়েছে, জানাজা পড়াতে হয়েছে।’
আন্দোলনে নিহত ফেনীর মহিপালের শ্রাবণসহ আরও ১০ শিক্ষার্থীদের পরিবার শোকস্তব্ধ। আহত হন ৭ গণমাধ্যমকর্মীসহ শতাধিক মানুষ।